১২৬১৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ- নতুন কৃষিঋণ নীতিমালা ঘোষণা

চলতি অর্থবছর ঋণ বিতরণে অতিরিক্ত কিছু ক্ষেত্র ও খাত চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কৃষিঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে।
২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ১২ হাজার ৬১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে হিসাব নিয়ে এই নতুন লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করা হয়েছে।
চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে গত বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
গত বছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ বছর কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে বছর লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ১১ হাজার ১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান গতকাল বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নীতিমালা ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ঘোষণা দেন।
সংবাদ সম্মেলনের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল সকালে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ব্যাংকার্স কমিটির সভায় নতুন নীতিমালা তুলে ধরে।
সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর মুরশিদ কুলী খান, নির্বাহী পরিচালক সুধীর চন্দ্র দাস, কৃষিঋণ ও স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এস এম মনিরুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নীতিমালা অনুসারে কৃষিঋণ বিতরণের নতুন ক্ষেত্র ও খাতগুলো হলো কমলা, আগর, স্ট্রবেরি, পান, মধু চাষ ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে টিস্যু কালচার, উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আতিউর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তেমন আক্রান্ত হয়নি। তার অন্যতম কারণ ভালো কৃষি উৎপাদন।
তিনি বলেন, কৃষি খাত দুই ভাবে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করে। খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখা এবং এর ফলে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়া।
গভর্নর বলেন, ‘বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে এখন বিভিন্ন দেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টির বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে। আর আমরা আগেভাগেই কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে গুরুত্ব দিয়েছি অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরি করতে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের এখন অনেকেই অনুসরণ করছে।’
প্রণীত কৃষিঋণ নীতিমালায় পাট চাষের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করেছে, যা পাট চাষের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। পাট চাষের ক্ষেত্রে এই যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাতে প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারও চেষ্টা করছে।
নীতিমালায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাম চাষের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মতে, ২৭টি জেলা/এলাকায় পাম চাষ করা সম্ভব। ইতিমধ্যে কোনো কোনো এলাকায় পামগাছ রোপণ করা হয়েছে।
গভর্নর বলেন, ‘আমি জেনেছি, পাম তেলের থেকে বায়ো-ডিজেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফলে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে কৃষকদের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাম চাষে আগ্রহী করার জন্য নীতিমালায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
আতিউর রহমান জানান, তিনি কয়েক দিন আগে দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কৃষি কাজে সৌরচালিত সেচব্যবস্থা উদ্বোধন ও কয়েকটি ব্যাংকের ক্ষুদ্র কৃষিঋণ কর্মসূচি (এনজিওর মতো গ্রুপ গঠন করে কৃষিঋণ বিতরণ কর্মকাণ্ড) অংশ নেন।
গভর্নর বলেন, ‘বরগুনায় সৌরশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
গভর্নর বলেন, সৌরশক্তির মাধ্যমে সেচ প্রদানের ব্যবস্থা একদিকে জাতীয় গ্রিডের ওপর চাহিদা চাপ লাঘব করবে এবং সৌরশক্তিনির্ভর সেচকাজে ভূ-উপরিস্থ পানি (সারফেস ওয়াটার) ব্যবহার করা হবে, যা পরিবেশের ভারসাম্যকে বজায় রাখবে। কৃষিঋণ নীতিমালায় সৌরশক্তিচালিত সেচযন্ত্র ক্রয়ে ঋণ প্রদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সৌরশক্তিচালিত সেচযন্ত্র প্রায় ২০ বছর ব্যবহার করা যায়। ফলে প্রাথমিক ব্যয় কিছুটা বেশি হলেও প্রকৃত অর্থে তা ব্যয় সাশ্রয়ী বলে মন্তব্য করেন গভর্নর।
আতিউর রহমান বলেন, ‘বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় এখনো এক ফসলি জমিই বেশি। এই সেচপদ্ধতি অনেকটাই প্রাসঙ্গিক বলে আমাদের বিশ্বাস।’
মুরশিদ কুলী খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও এ বিষয়ে মনোযোগী ও উদ্যোগী হয়েছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
এ প্রসঙ্গে আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ১০ টাকায় ৮৮ লাখ কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
তিনি জানান, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সম্প্রতি বলেছেন, সে দেশে কৃষকের জন্য সহজে ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া উচিত হবে।
কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রায় এবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক পাঁচ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক (বিআরডিবির কিছু অংশসহ) দুই হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংক তিন হাজার ৪৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, বিদেশি ব্যাংক ৫৮২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বিআরডিবি ও বিএসবিএল মিলে ৭৭১ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বিদেশি ব্যাংকগুলো নিজেরা কৃষিঋণ বিতরণ করছে না। তারা ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে এই ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। চলতি বছর থেকে তাদের এই ঋণ তদারকি করতে বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.