লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক -হজ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পবিত্র হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোকন। আরবি ‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনো স্থান দর্শনের সংকল্প করা, কোনো পবিত্র স্থানে গমন করার ইচ্ছা করা, জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞা করা প্রভৃতি। ইসলামের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে কাবাগৃহ এবং এর সংলগ্ন কয়েকটি সম্মানিত স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুসারে অবস্থান করা, জিয়ারত করা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার নামই হজ। নবী করিম (সা.) উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘হে মানবগণ! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন, অতএব তোমরা হজ পালন করো।’ (মুসলিম)
ইসলামে হজ একটি দৈহিক ও আর্থিক সংগতিপূর্ণ সার্বিক ইবাদত, যা একজন মুসলমান জিলহজ মাসের ৯-১৩ তারিখ পর্যন্ত বায়তুল্লাহ শরিফে পৌঁছে যথাযথভাবে পালন করে থাকেন এবং যা বিশ্বমানবতা ও তাওহিদী পয়গাম থেকে উত্সারিত স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের এক বাস্তব দৃষ্টান্ত। হজের মর্মকথা হলো যে ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) যে সদিচ্ছা ও বিশ্বাসের দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন আবশ্যিকভাবে জীবনে একবার তা পালন করবেন। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা মক্কায়, এটা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। যে এর ভেতরে প্রবেশ করে সে নিরাপদ। আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরে হজ করা তার অবশ্যকর্তব্য।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭)
আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণের মুহুর্মুহু ধ্বনিতে ৯ জিলহজ মক্কা মোয়াজ্জমায় সুবিশাল আরাফাতের ময়দান মুখরিত ও প্রকম্পিত করে বিশ্বের লাখ লাখ মুমিন বান্দা মহাসম্মিলনী পবিত্র হজব্রত পালন করেন। ভাষা, বর্ণ ও লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বের প্রায় ১৭২টি দেশের প্রায় ৩৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ পালনের লক্ষ্যে মিনা থেকে আরাফাত ময়দানে গমন করেন। তাঁরা পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে আত্মশুদ্ধির শপথ ও আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করে সৃষ্টিকর্তার দরবারে ঐকান্তিক আবেদন জানান। মক্কা শরিফ থেকে হজের ইহরাম পরিহিত লাখ লাখ নর-নারী ধর্মীয় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাকা’ অর্থাত্ আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আপনার মহান দরবারে হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নিয়ামত এবং সব রাজত্ব আপনারই, আপনার কোনো শরিক নেই—এ হাজিরী তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনাতে এসে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করেন।
বাদ জোহর মিনা থেকে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে করতে আরাফাতের সুবিশাল প্রান্তরে লাখ লাখ মুসলমান উপস্থিত হন। জোহরের নামাজের জামাতের আগে আরাফাত ময়দানের মসজিদে নিমরার মিম্বারে দাঁড়িয়ে হাজিদের উদ্দেশে হজের খুতবা দেওয়া হয়, যাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, বিশ্ব শান্তি ও কল্যাণের কথা ব্যক্ত করা হয়। খুতবা শেষে জোহর ও আসরের ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়ে জোহর ও আসরের কসর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সব হজযাত্রী আরাফাত ময়দানেই অবস্থান করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর জিকির-আজকারে মশগুল থাকেন। হজের দিনে সারাক্ষণ আরাফাতে অবস্থান করা ফরজ। হজ পালন তথা এদিনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের প্রতিদান হলো আল্লাহ সেসব হজযাত্রী মুমিন বান্দাদের নিষ্পাপ ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে, আর কোনো প্রকার কুকর্ম না করে, সে ব্যক্তি যে দিবসে তার মাতা তাকে প্রসব করেছিল সে দিবসের ন্যায় বে-গুনাহ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সূর্যাস্তের পরপরই হাজিগণ মুযদালিফায় এসে এশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা মাঠে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদত করেন। পরের দিন ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিগণ কিছুক্ষণ অবস্থান করেন এবং সূর্যাস্তের আগেই মিনার উদ্দেশে রওনা হন। মিনাতে পৌঁছে বড় শয়তানকে একে একে ৭টি কঙ্কর মারার পর কোরবানি দিয়ে মাথার চুল কেটে গোসল করে ইহরামমুক্ত হন। মিনাতে হাজিগণ আরও দুই দিন থাকেন। পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে চিহ্নিত স্থানসমূহ লক্ষ্য করে প্রতিটিতে ৭টি করে কঙ্কর মারেন। ইতিমধ্যে মক্কায় গিয়ে কাবাগৃহ তাওয়াফ করে আবার মিনায় ফিরে আসেন। এটাকে বলা হয় কাবা শরিফের ফরজ তাওয়াফ।
১২ জিলহজ শেষবারের মতো শয়তানকে নিয়ম অনুযায়ী কঙ্কর মেরে সূর্যাস্তের আগে মক্কায় ফিরে আসেন, আর যদি সূর্যাস্তের আগে ফিরে আসতে ব্যর্থ হন তবে মিনা থেকে ১৩ জিলহজ কঙ্কর মেরে মক্কায় ফেরেন। মক্কায় ফিরে এসে বিদায়ী তাওয়াফ করে হাজিগণ মদিনায় যান। যাঁরা আগে যাননি তাঁরা মদিনার পথে, আর যাঁরা হজের আগে মদিনা সফর করেছেন তাঁরা নিজ নিজ দেশের উদ্দেশে রওনা হন। হজের সফরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—নবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা। মূল হজ শুরুর আগে মদিনাতে যাওয়া যেতে পারে বা হজের কার্যাবলি শেষ করেও যাওয়া যায়। হজ আল্লাহপ্রেমকে জাগ্রত করে আর নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারতের মাধ্যমে সেই প্রেমের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়।
ইসলামে হজের ধর্মীয় গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। পবিত্র হজ উপলক্ষে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান নফল রোজা ও ইবাদত বন্দেগি করেন। ৯ জিলহজ হাজিদের আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পরের দিন ফজরের নামাজ থেকে ১৩ জিলহজ আসরের নামাজ পর্যন্ত প্রত্যেক নামাজের পর উচ্চস্বরে এ তাকবিরে তাশরিফ বলতে হয়, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ।’
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত হজ পালনকারীদের নিকটবর্তী। অতঃপর হজ পালনকারী বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের কাছে গৌরব করে বলতে থাকেন, এরা কিসের সংকল্প করেছে?’ উত্তরে ফেরেশতারা বলেন, ‘হে আল্লাহ! এরা হজের সংকল্প করেছে।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি এদের হজ কবুল করলাম, আর হজের বিনিময়ে একমাত্র জান্নাত দান করব।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘মকবুল হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সারা বিশ্বে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন রচনায় হজের তাত্পর্য অতুলনীয়। প্রতিবছরই হজের সময় মুসলমানদের মহামিলনের সমারোহ ঘটে। হজের দিনে পবিত্র মক্কা ও আরাফাতের ময়দানে বিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ হাজি নিবিড়ভাবে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ অনুভব করেন। তাওহিদী পতাকাতলে সমবেত হওয়ার এমন নজির অন্য কোনো ধর্মে সাধারণত পরিলক্ষিত হয় না। একই ঐকতান ও একই মহান উদ্দেশ্য লাভের আশায় আল্লাহর প্রতি একাগ্রতার একনিষ্ঠ প্রয়াস সমগ্র বিশ্বকে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিতে আলোড়িত করে তোলে। নানা দেশের, নানা বর্ণের এবং নানা ভাষার মানুষের মুখে যখন উচ্চারিত হয়, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ আরাফাতের ময়দানে এহেন ভ্রাতৃপ্রেম খুলে দেয় এক নতুন দিগন্ত। বিভিন্ন বর্ণ ও ভাষার মানুষগুলো মহান সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহর তাঁবেদার হয়ে যায়। গোটা বিশ্বের মুসলমানরা তখন একই মিল্লাতের মানুষ। পবিত্র হজে সব মানুষ এক আদমের সন্তান তথা উম্মতে মুহাম্মদী, এটাই আমাদের শিক্ষা দেয় এবং ইবাদতের পাশাপাশি মহামিলনের মধ্যে ইহকালীন জগতে শান্তিকামী মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্য স্থাপনের অনন্য অতুলনীয় নজির স্থাপন করে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.