বলিভারীয় বিপ্লব ও শান্তি -ভেনেজুয়েলা by ফিদেল কাস্ত্রো

শেভেজকে আমি ভালো করে চিনি, ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার জনগণকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো কোনো শক্তিপরীক্ষা হতে দিতে শেভেজ সবচেয়ে অনাগ্রহী। কিউবা দ্বীপের পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিমাংশের অধিবাসীরা যে ভ্রাতৃসুলভ বন্ধনে আবদ্ধ, তেমনি সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের।
কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন শেভেজ—মার্কিনীদের এ ধরনের অবমাননাকর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী এক মার্কিন পত্রিকা সম্প্রতি ‘ওয়ার ড্রামস’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সাত দশকের ভেতর কলম্বিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুতর এই হুমকিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কারণ এ হুমকি আসছে এমন এক দেশ থেকে যার প্রেসিডেন্টের সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে...’ এ ধরনের বক্তব্য ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টের জন্য অমর্যাদাকর।
সেই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, ‘আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকারে শেভেজের বিরোধীদের তিনি তীব্র আক্রমণ করেন, তাদের সরানোর চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে কারাকাসের মেয়র এমন আচরণের শিকার হয়েছেন...এখন কলম্বিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যে গভর্নররা তাঁর শাসন মানতে নারাজ তাঁদের বিহিত করতে চান তিনি...কলম্বিয়ার সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ বা আধাসামরিক বাহিনী ভেনেজুয়েলার ভূমিতে ঢুকে অভিযান চালাতে পারে এমন অভিযোগকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে শেভেজ সরকার সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত করে দিতে পারে।’
এসব কথা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পরিকল্পনা এবং ভেনেজুয়েলার অভিজাত শ্রেণী ও প্রতিবিপ্লবীদের সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতার ন্যায্যতাই শুধু প্রতিপাদন করে।
কাকতালীয়ভাবে, এই সম্পাদকীয় প্রকাশের সময় শেভেজ একটি কলামে বিশ্লেষণ করেন কলম্বিয়া কর্তৃক সাতটি সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি।
সেই কলামে বলিভারীয় প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত স্পষ্ট ও সাহসিকতার সঙ্গে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কলম্বিয়া কাউকে নিরাপত্তা ও সম্মান দিতে পারে না; এমনকি নিজ দেশের নারী-পুরুষদেরও না। যে দেশ নিজের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে তার পক্ষে এমন নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়।’
শেভেজ সত্যিকারের বিপ্লবী, সাহসী কর্মী। তিনি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। যে নয়া-উদারনৈতিক সরকারগুলো ভেনেজুয়েলার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করেছিল এবং জনগণের ওপর নিপীড়ন ও গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছে, ধীরে ধীরে তাঁর চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, পরিপক্বতা এসেছে। সামরিক বাহিনীতে কাজের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে, কিন্তু তিনি অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেননি।
তথাকথিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের পরম স্বাধীনতার মধ্য থেকে তিনি সামাজিক বিপ্লবের কঠিন পথে এগিয়েছেন। এই সময় সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া অভিজাত ও সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। শেভেজের লড়াইয়ের মহত্ব এখানেই।
অভ্যুত্থান ও দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অপপ্রচার সত্ত্বেও মাত্র ১১ বছরে ভেনেজুয়েলা শিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতিতে যে অর্জন করেছে তার নজির দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
নানা জটিল কায়দা ব্যবহার করে সফল না হয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার মতো ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেনি; কারণ বৈদেশিক জ্বালানির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তারা বলিভারীয় প্রক্রিয়া এবং ক্যারিবীয় ও মধ্য আমেরিকান দেশগুলোকে ভেনেজুয়েলা উদারভাবে যে জ্বালানি সহায়তা দিচ্ছে এবং দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, রাশিয়া এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যে বিপুল বাণিজ্য তার বিরুদ্ধে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি মহাদেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ বলিভারীয় বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতিশীল। আর সে দেশের সরকারের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক সাম্রাজ্যের জন্য বিচলিত হওয়ার মতো। বলিভারের ভেনেজুয়েলা এবং মার্তির কিউবা যুক্তি ও ন্যায্যতাভিত্তিক নতুন ধরনের সম্পর্কের সূচনা করেছে।
প্রচণ্ড জ্বালানি সংকটের সময়ে ক্যারিবীয় দেশগুলোকে ভেনেজুয়েলা উদারভাবে সহায়তা দিয়েছে। ভেনেজুয়েলা এখন যে সমস্যা মোকাবিলা করছে তা কিউবাতে বিপ্লবের সময়ে আমাদের সমস্যার থেকে একেবারে আলাদা। মাদক পাচার, সংঘবদ্ধ অপরাধ, সামাজিক সহিংসতা এবং আধাসামরিক বাহিনীর কথা আমাদের সময়ে বলতে গেলে শোনাই যেত না। পুুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও ভোগবাদী সমাজ তখনো যুক্তরাষ্ট্রকে বিশাল মাদকের বাজারে পরিণত করেনি। কিউবার বিপ্লবের জন্য তখন মাদক পাচার মোকাবিলা কঠিন ছিল না।
এখন মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এগুলো মস্তবড় আসন গেড়ে বসেছে। বাণিজ্যের অসম শর্ত, সংরক্ষণবাদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাতিন আমেরিকার সমাজে অনুন্নয়ন, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানহীনতা এবং মাদকের বিশাল বাজার তৈরির ফলে মাদক পাচার ও সংঘবদ্ধ অপরাধ। মাদক পাচার ও অপব্যবহার রোধে ধনী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অসামর্থ্য লাতিন আমেরিকাতে মাদক উত্পাদনের কাঁচামাল হিসেবে কিছু উদ্ভিদের চাষের রাস্তা করে দিয়েছে।
সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতা থাকার কারণেই শেভেজ জানেন যে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক চুক্তির বৈধতা দানের অছিলা হিসেবে ব্যবহার করছে, যে চুক্তি স্নায়ুযুদ্ধোত্তর দুনিয়াব্যাপী প্রাধান্য বিস্তারের মার্কিন যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিমান ঘাঁটি স্থাপন, কার্যক্রম চালানোর অধিকার এবং মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের কলম্বিয়ার ভূমিতে দায়মুক্তি দেওয়ার সঙ্গে মাদক চাষ, উত্পাদন ও পাচারের কোনো সম্পর্ক নেই। বৈশ্বিক এ সমস্যা শুধু দক্ষিণ আমেরিকায়ই ছড়াচ্ছে না, বিস্তার ঘটছে আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলেও। ব্যাপক মার্কিন সেনা উপস্থিতি সত্ত্বেও আফগানিস্তানে এ অবস্থা দেখা যায়।
সামরিক ঘাঁটি তৈরি, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় হামলা, যুদ্ধ ও লুণ্ঠন চালানোর জন্য মাদককে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। যাঁরা ভাবছেন ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার জনগণের মধ্যে বিভক্তি তাঁদের প্রতিবিপ্লবী পরিকল্পনার সাফল্য বয়ে আনবে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ভেনেজুয়েলার সবচেয়ে ভালো শ্রমিকদের অনেকে কলম্বিয়ার নাগরিক; বিপ্লব তাদের, তাদের পরিবারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নাগরিক অধিকার ও অন্যান্য সুবিধাদি দিয়েছে। ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার অধিবাসী এক সাথেতাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করবে, একই সঙ্গে তারা শান্তি ও মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।

No comments

Powered by Blogger.