দখাদ্যপুষ্টি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

বিশ্বমানবতার কল্যাণময় জীবনব্যবস্থা ইসলামে মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ পুষ্টিকর খাদ্য, পানীয় ও স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বহু পুষ্টিকর ফল, ফসল ও শস্যের কথা পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে। বিশেষত মধু, মাছ, যায়তুন, লৌহ, কালোজিরা, দুধ ইত্যাদির গুণাগুণ বর্ণনা করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘তিনিই সেই প্রভু যিনি সৃষ্টি করেছেন নানা রকমের বাগান গুল্মলতাবিশিষ্ট ও স্বীয় কাণ্ডে দণ্ডায়মান বৃক্ষসমূহ, আরও বিবিধ স্বাদের খেজুর ও ফসল। সৃষ্টি করেছেন যায়তুন ও আনার, যা পরস্পর সমস্বাদবিশিষ্ট এবং ভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট। তোমরা তার উত্পাদন খাও যখন ফল আসে’— সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৪১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জমিনে উত্পন্ন করেছি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, যায়তুন ও খেজুর বৃক্ষ’— (সূরা আবাসা, আয়াত: ২৭)।
ইসলাম ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি দৈহিক উন্নতির প্রতিও যথেষ্ট যত্নশীল। সুস্থ-সবল দেহমন ছাড়া সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করা সম্ভব নয়। আর সুস্থ-সবল দেহ গঠনের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের একান্ত প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে, সব ফলেই কমবেশি পুষ্টি রয়েছে। পুষ্টি মানবদেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যা দেহের তাপ ও শক্তি জোগায়, শরীরের বৃদ্ধি সাধন করে, ক্ষয়পূরণ করে, রোগ প্রতিরোধ করে এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। মানবদেহের জন্য খাদ্য হিসেবে ফলমূল বিশেষ উপকারী, তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এটিকে বিশেষ নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য বৃষ্টি দ্বারা উত্পাদন করেন ফসল, যায়তুন, খেজুর, আঙুর এবং সর্বপ্রকার ফল, নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১১)
ইসলামের আবির্ভাবস্থল আরব দেশে খেজুর, আঙুর, যায়তুন, আনার বেশি উত্পন্ন হতো বলে আল্লাহ তাআলা এসবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। খেজুর সহজে হজম হয়। এতে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও সব ধরনের ভিটামিন রয়েছে। খেজুর কেবল একটি পুষ্টিকর খাদ্যই নয়, এটা বহু রোগের প্রতিষেধকও বটে। খেজুর প্রসূতি মায়ের জন্য খুবই উপকারী। গর্ভবতীকে লৌহের স্বল্পতা পূরণের জন্য একটি করে খেজুর খাওয়ানো হলে তার সর্বাঙ্গে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, নবজাত শিশুর শারীরিক শক্তিও বৃদ্ধি পায়। খেজুর ভক্ষণে স্মৃতিশক্তি বাড়ে এবং কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রসূতি অবস্থায় তোমরা স্ত্রীকে খেজুর খাওয়াবে। কেননা যখন বিবি মরিয়ম (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.) ভূমিষ্ঠ হলেন তখন বিবি মরিয়মের খাদ্য ছিল খেজুর। যদি আল্লাহর ইলমে এর চেয়ে উত্তম আর কোনো খাবার থাকত, তাহলে তিনি তারই ব্যবস্থা করতেন।’ নবীজির কাছে মাখন মিশ্রিত খেজুর অত্যধিক প্রিয় ছিল। তাই তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকালে সাতটি করে ‘আজওয়া’ খেজুর খাবে, তাকে বিষ ও জাদু কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি)
পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মধুতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, খনিজ, ভিটামিন ও পানি। এসব উপাদান মানবদেহের জন্য খুবই জরুরি। মধু জ্বর, কাশি প্রভৃতি রোগের জন্য উত্কৃষ্ট ওষুধ। মৌমাছিরা নানা গাছের ফুল থেকে এ পুষ্টিসমৃদ্ধ সুস্বাদু খাবার সংগ্রহ করে। পবিত্র কোরআনে মধুকে রোগনাশিনী ও আরোগ্যদায়ক ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘তার (মৌমাছির) পেট থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন রঙের পানীয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার’— (সূরা আন-নহল, আয়াত: ৬৯)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক মাসে তিন দিন সকালে মধু খাবে, তার কোনো বড় ধরনের রোগ হবে না।’ (মিশকাত)
দুধ ও মধু হাজারো ফুল ও ফুলের নির্যাসের মাধ্যমে তৈরি। আল-কোরআনে গবাদিপশুর নানা উপকারিতা থেকে একটি বিশেষ পুষ্টিকর পানীয় দুধের সন্ধান দিয়ে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুর মাঝে রয়েছে বহু উপকারিতা ও পানীয় বস্তু।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত: ৭৩)। দুধ কেবল একটি সুষম খাদ্যই নয়, এটি জান্নাতি খাবারও। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘বেহেশতে দুধের এমন নহর প্রবাহিত হবে, যার স্বাদ কখনো পরিবর্তন হবে না।’ (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৫)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘স্বচ্ছ নির্মল নির্ভেজাল খাঁটি দুধ পানকারীদের জন্য সুস্বাদু ও উপাদেয়।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৬৬)
দুধের উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, দুধ শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে, শরীরের শুষ্কতা বিদূরিত করে এবং শিগগিরই পরিপাক হয়ে খাদ্যের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। মুখের লাবণ্যতা বৃদ্ধি করে, দূষিত পদার্থ বের করে দেয় এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। দুধ আদর্শ খাবার। এর পুষ্টিগুণ সত্যিই অতুলনীয়। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই গাভির দুধ পান করবে। কেননা এর মধ্যে শেফা রয়েছে।’
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সমুদ্র থেকে তাজা খাবার আহরণ করতে বলেছেন। সামুদ্রিক খাবারের মধ্যে মাছ অন্যতম পুষ্টিকর একটি খাদ্য।
কালোজিরাকে রান্নার কাজে ও ঔষধি ভেষজ হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) কালোজিরার সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা ভেষজ চিকিত্সা, বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও অনুসন্ধানের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এই কালোজিরা ব্যবহার করবে, কেননা এতে একমাত্র মৃত্যুরোগ ব্যতীত সর্বরোগের শেফা বা আরোগ্য রয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। নবী করিম (সা.) নিজে বেছে বেছে পুষ্টিকর খাবার খেয়েছেন, অন্যদের সেদিকে আকৃষ্ট করে নানাবিধ পুষ্টিকর খাদ্যের সন্ধান দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিটি সত্য সুন্দর কথাই অসাধারণ প্রজ্ঞা ও হিকমতে পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর মুখনিঃসৃত অমিয়বাণীতে দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা জনসাধারণের কল্যাণে চিরশাশ্বত ও চিরকল্যাণকামী। সেই সূত্র ধরেই মহানবী (সা.)-এর চিকিত্সা পদ্ধতি জনসেবায় এক মহামূল্যবান রত্নভাণ্ডার হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। এমনিভাবে নবীজি তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে শেফা লাভের জন্য পবিত্র কোরআনের আলোকে খাদ্য-পুষ্টি, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পথ্যের মাধ্যমে চিকিত্সা করার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে মানবজাতি সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ করে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.