ক্যারল সালোমন: একটি বিলম্বিত শ্রদ্ধাঞ্জলি -খোলা চোখে by হাসান ফেরদৌস

ক্যারল সালোমন মারা গেছেন—এ খবরটা ঢাকা বা কলকাতার কোনো পত্রিকাতেই চোখে পড়েনি। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন, তাদের একটি ঘোষণা ইন্টারনেটে এসেছিল বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কারও তা জানার কথা নয়। পরে ইন্টারনেট ঘেটে দেখেছি, সিয়াটলের একটি স্থানীয় পত্রিকায় কয়েক লাইনের দুর্ঘটনার সংবাদ ছাপা হয়েছিল; কিন্তু ক্যারল সালোমন কে, কী তাঁর গুরুত্ব, এর বিন্দুমাত্র উল্লেখ সেখানে নেই। আমাদের পুরোনো বন্ধু, নাট্যকার ও অধ্যাপক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় লন্ডন থেকে না জানালে তাঁর মৃত্যুর কথা হয়তো অজানাই থেকে যেত।
কী আশ্চর্য, বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার এমন এক পরম বন্ধু চলে গেলেন, তাঁকে নিয়ে কেউ একটি লাইনও লিখল না!
অধ্যাপক সালোমন ৩০ বছর ধরে লালন ফকিরের গান ও তাঁর জীবন নিয়ে কাজ করেছেন। সে উদ্দেশ্যে বারবার বাংলাদেশে, বিশেষ করে লালনের জন্মস্থান কুষ্টিয়ায় ফিরে গেছেন। সুদীপ্তের কাছে শুনেছি, তিনি চমত্কার বাংলা বলতেন। লালনের গানের অর্থ বোঝা খুব সহজ নয়। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিলেন এই গানের মর্ম বুঝতে, তাঁর ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে সেই গানের গূঢ়ার্থ পৌঁছে দিতে। কথা ছিল, দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি ফের বাংলাদেশে যাবেন। হলো না। সিয়াটলের শহরতলিতে তাঁর বাসা থেকে সাইকেলে চেপে আসার সময় পেছন থেকে ঘাতক গাড়ির আকস্মিক আক্রমণে প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবে নিহত হন ক্যারল। তারিখটা ছিল ১৩ মার্চ ২০০৯।
ক্যারলের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না, যদিও তাঁর কথা বিস্তর শুনেছি, বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখাও পড়েছি। সুদীপ্ত নিজে লালন নিয়ে কাজ করছেন কম করে হলেও কুড়ি বছর, তাঁর কাছ থেকেই প্রথম ক্যারলের গল্প শোনা। লালনের জীবনভিত্তিক তাঁর একক অভিনীত নাটক মনের মানুষ তৈরির সময় ক্যারল তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন বাউলের গান রেকর্ড করে এনেছিলেন ক্যারল। বিনা আপত্তিতে সামান্য অনুরোধ করা মাত্রই সুদীপ্তের সঙ্গে সেসব দুর্লভ রেকর্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন তিনি। দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুর পর ক্যারলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার বিবরণ দিয়ে একটি ব্যক্তিগত রচনায় সুদীপ্ত এই ‘বিদেশি বাঙালি মায়ের’ সঙ্গে আমাদের বিস্তারিতভাবে পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, কুষ্টিয়ায় ক্যারল শুধু লালনের গান খুঁজতে যেতেন না—সে কারণ তো ছিলই—কিন্তু যেসব লালনসাধকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, যাঁদের কারও কারও সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তাঁদের টানও কম ছিল না। যখন যেভাবে পেরেছেন, তাঁদের টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করেছেন। নাম উল্লেখ না করে সুদীপ্ত এক লালনসাধক ও তাঁর স্ত্রীর কথা বলেছেন। ক্যারলের সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সে কথা স্মরণ করে ক্যারল ও রিচার্ডের একমাত্র পুত্রের নামানুসারে লালনসাধকদ্বয় তাঁদের পুত্রের নাম রেখেছেন জেসি। ২০০৮ সালে সুদীপ্ত নিজে কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলেন লালনের ওপর তাঁর গবেষণার সূত্রে। ক্যারল সে কথা জানতে পেরে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, কিছু নগদ টাকা যেন তিনি সেই দুই সাধক-সাধিকার কাছে রেখে আসেন। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মস্থলে ফিরেই সুদীপ্ত দেখেন, তাঁর মেইলবক্সে ক্যারলের পাঠানো একটি চেক।
বাউলদের ব্যাপারে আমরা মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালিরা যে এক ধরনের দ্বিচারিতায় ভুগি, ক্যারল সে কথা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। বাউল গানের ওপর লেখা তাঁর একটি বহুল পঠিত প্রবন্ধ ‘বাউল সংস্’, তাতে কিঞ্চিত পরিহাসের সঙ্গে তিনি লিখেছেন, বাউল গান বাঙালি মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু এই বাউল ঐতিহ্যের ব্যাপারে কোথায় যেন একটা দ্বিধা তাদের মধ্যে কাজ করে। এক দিকে তারা বাউলদের মাথায় তুলে রাখে, তাদের সুফি সাধক বলে সম্মান করে। অন্য দিকে বাউলদের তান্ত্রিক জীবনচারিতা, বিশেষত তাঁদের যৌন আচার-আচরণ তারা ঘৃণার চোখে দেখে। রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাউলদের সঙ্গে পরিচিত হয়, সম্ভবত সেটাও একটা কারণ বাউলদের নিয়ে একপেশে ও ভুল ধারণা গড়ে ওঠার। বাউল-দর্শনকে আমরা বিশ্ব মানবতার এক বিশেষ আয়নায় দেখার চেষ্টা করি। ক্যারলের বক্তব্য, এর ফলে বাউল গবেষণা একপেশে হয়ে পড়েছে। বাউল-দর্শনের নামে তাঁদের ধর্মচর্চার আসল চেহারাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। বাউল, তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক, তারা সবাই এক অভিন্ন যৌন জীবনচারিতায় অভ্যস্ত, যে জীবনচারিতা বাউল-দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু এ বিষয়টি লুকিয়ে রাখতেই আমাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।
লালনের প্রতি ক্যারলের একটি অতিরিক্ত ভালোবাসা ছিল, এ কোনো গোপন কথা নয়। লালনের গানের অর্থ বোঝার জন্যই কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় তিনি দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। গত ২০-২৫ বছরে তাঁর অনেক গান ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠক-গবেষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ক্যারলের অনুবাদের একটি প্রধান গুণ, যতটা সম্ভব অবিকৃতভাবে, সরল ভাষায় লালনের গানের মর্মার্থ পৌঁছে দেওয়া। লালনের বিখ্যাত গান ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত’, তাঁর এই অনুবাদটি লক্ষ করুন:
Everyone asks: ‘Lalan, what’s your religion in this world?
Lalan answers: ‘How does religion look?’
l’ve never laid eyes on it.
Some wear malas [Hindu rosaries] around their necks,
some tasbis [Muslim rosaries], and so people say
they’ve got different religions.
But do you bear the sign of your religion
when you come or when you go?
আমরা জানি, লালনের জীবনেতিহাস রহস্যাবৃত, তাঁর জাতপাত নিয়ে যে বিতর্ক, তার কারণও সেই রহস্যের আবরণ। লালন নিজে কেন তাঁর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলে যাননি, তার ব্যাখ্যায় ক্যারল লিখেছেন, এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, বাউলমন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পর লালন গৃহস্থালি, পরিবার ও প্রচলিত জীবনযাপন পরিত্যাগ করেন। ফলে জাতপাতের প্রমাণ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন তিনি দেখেননি। অন্য কারণ, তিনি বিশেষ কোনো ধর্মমত অনুসরণে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর কাছে ‘মানবধর্ম’ই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্মবিশ্বাস। ক্যারলের বিবেচনায়, বাউলদের সঙ্গে সুফি ও বৈষ্ণবীয়দের স্পষ্ট নৈকট্য আছে। এদের মতো বাউলরাও ঈশ্বরসাধনায় মানবপ্রেমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। বাউলদের কাছে প্রেম হলো ঈশ্বরের সন্ধানে ব্যক্তির আকুতির প্রকাশ। অনেক বাউল গানে এই প্রেমের প্রকাশ ঘটে বিরহ-বেদনার উচ্চারণে। যে অধরা ঈশ্বরকে বাউল খোঁজে, তাকে পাওয়া যায় অন্তরে, লালন যাকে বলেন ‘মনের মানুষ’। মনের ভেতরে সেই ঈশ্বরের বাস, তাকে দেখেও আমরা দেখি না, চিনেও আমরা চিনি না। সে কারণেই লালনের বিলাপ, ‘আমার আপন খবর আপনার হয় না’।
ক্যারল ও তাঁর অধ্যাপক স্বামী রিচার্ড সালোমন প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ছাত্রজীবন থেকেই মেতে ছিলেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যারল পিএইচডি করেন বাংলা ভাষার ওপর, আর রিচার্ড করেন সংস্কৃত নিয়ে। দুজনেই ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই দুজনের উত্সাহেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে নিয়মিত চায়ের আড্ডা বসত। সেই আড্ডায় ক্যারল অনেকবার তাঁর করা লালনের অনুবাদ পড়ে শুনিয়েছেন। বাংলা ভাষা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লেখাটি হলো বাংলা ভাষায় লিঙ্গ ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে কীভাবে, তার ওপর। ভারতীয় ধর্মচর্চা, বিশেষত ভাষার ভেতর দিয়ে এর সাংস্কৃতিক প্রকাশ কীভাবে ঘটে—এমন একটি জটিল নৃতাত্ত্বিক বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তিনি। মাত্র ছয় মাস আগে ক্যারল মার্কিন সরকারের কাছ থেকে একটি বড় ধরনের অনুদান পেয়েছিলেন ইন্টারনেটের উপযোগী বাংলা ভাষা শিক্ষার উপকরণ তৈরির জন্য। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ নামে অবাঙালিদের জন্য সহজ পদ্ধতিতে বাংলা শিক্ষার কিছু কিছু কাজ তিনি গুছিয়েও এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ ছিল লালনকে নিয়ে। কয়েক বছর ধরেই তিনি লালনের গানের একটি আকরগ্রন্থ লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সেই বইয়ের নামও ঠিক হয়েছিল সিটি অব মিররস: অ্যান এনোটেটেড ট্রানসলেশন অব সিলেক্টেড সংস অব লালন ফকির। এই আরশীনগর তাঁর লেখা শেষ হলো না।
বাঙালি না হয়েও বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের ভালোবেসেছিলেন ক্যারল সালোমন। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি থাকল বিলম্বিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নিউইয়র্ক, ১১ অক্টোবর ২০০৯
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.