সময় হয়েছে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে নেওয়ার -সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by ফরিদা আখতার

কোনো রকম ভনিতা না করেই বলছি, ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে নিতে হবে, অর্থাত্ আগে যে নিয়মে আমরা চলতাম, তা-ই করতে হবে। গত ১৯ জুন রাত ১১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজউকের ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে ১২টায় নিয়ে দিনের সূত্রপাত করা হয়েছিল। এখন আবার রাজউকের ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে আগের অবস্থায় আনার সময় হয়েছে। এটাই কথা ছিল।
তখন বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু যুক্তি দিয়েছিলেন, এতে বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে ২০০ মেগাওয়াট। প্রাথমিকভাবে চার মাসের জন্য এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলে শুরু হয়েছিল। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাস হয়ে যাচ্ছে; অতএব, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, আপনি দয়া করে আপনার কথা রক্ষা করুন। বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়নি, কিন্তু মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। কাজেই ফলাফল ভালো নয়। অতএব, ভুক্তভোগীদের কথা শুনুন। ঘড়ির কাঁটা ঠিক করে দিন।
ইংরেজিতে একে বলা হয় ডে লাইট সেভিং টাইম বা ডিএসটি। অর্থাত্ এই চর্চা বিদেশে আছে, বিশেষ করে যেসব দেশে দিনের আলো কম-বেশি হওয়ার ব্যাপারটা অনেক তাত্পর্যপূর্ণ। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সেটা খুব কার্যকর নয়। তবু যখন ঘরির কাঁটা আগানো হয়েছিল (অর্থাত্ জুন মাসে), তখন ছিল দিন বড়। প্রায় সাতটায় সূর্য ডুবত। সকালও হতো আগে। ভোর পাঁচটার মধ্যে আলো হয়ে যেত। কাজেই ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়ার কারণে যারা ঘুম থেকে ছয়টায় উঠত, তারা নতুন নিয়মে পাঁচটায় উঠেছে। দিন বড় হওয়ার কারণে সকাল বেলাটা খুব বোঝা না গেলেও সন্ধ্যায় এসে ধাক্কা খেয়েছে অনেকে। নামাজের সময়সূচি সূর্যের নিয়মে চলেছে। আসরের নামাজের আজান দিচ্ছে; প্রায় ছয়টা, সাতটা, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, কিন্তু সূর্য ডুবছে না। বড় যন্ত্রণা। রোজার দিনে বেশ অসুবিধা হয়েছে সবার। বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা পড়েছেন বিপদে। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সময় বিছানা থেকে টেনে তুলতে হয়েছে, এখন আরও বেশি হচ্ছে। কারণ অন্ধকার থাকতেই তুলতে হচ্ছে। স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে বলে ঠিকমতো নাশতাও খেতে পারছে না। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরা রাত নয়টায়ও যদি ঘরে না ফেরে, বলার কিছু নেই। কিছু বললে তারা বলে, এটা তো আসলে আটটা মাত্র।
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়ার প্রথম দিকে বেশ অসুবিধা হয়েছিল, এটা সবাই মানে। পত্রিকার খবর থেকেই কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। জাতীয় সংসদের স্পিকারই বোধহয় ঘড়ির কাঁটা বদলাননি, তাই তিনি এক ঘণ্টা দেরিতে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বাতিল হয়ে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত্ (সমকাল ২১ জুন, ২০০৯)। কারণ সময় নিয়ে বিভ্রাট। এমনি অনেক ঘটনা আছে। কোনো সভা-সেমিনার করলে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে অংশগ্রহণকারীদের আসার সময় নিয়ে একটা সমস্যা ঘটে। যারা প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে আসেন তাঁরা বলেন, ‘ডিজিটাল টাইম মনে ছিল না, অ্যানালগ টাইমে এসেছি।’ এটা অনেক সময় দেরির অজুহাত হিসেবে ভালোই কাজে লাগে। ঠিক যেমন যানজটের দোহাই প্রায় সবাই দেয়। মফস্বল শহরগুলোতে এখনো এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। গ্রামে তো নয়ই।
কথা হচ্ছে, বিদ্যুত্ কি সাশ্রয় হয়েছে? হয়নি, হবেও না। বরং হিসাব করলে দেখা যাবে আরও বেড়েছে। আমার এক সহকর্মী তাঁর সকালবেলার সময়ের হিসাব দিয়ে বলল, ‘এক ঘণ্টা আগে উঠে আমি রুমের লাইট, পাকঘরের লাইট, বাথরুমের লাইট, করিডরের লাইট সবই জ্বালাই। এটা আমি এক ঘণ্টা পরে উঠলে জ্বালাতে হতো না।’ অর্থাত্ সকালবেলা এক ঘণ্টা বেশি সময় বিদ্যুত্ ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূর্য তো তার নিয়েমেই উঠছে। এখন অর্থাত্ অক্টোবর মাসে দিন ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। সকাল হচ্ছে দেরিতে, বর্তমান ঘড়ির কাঁটায় ছয়টা ৫৪ মিনিটে (১৩ অক্টোবর)। আর সন্ধ্যাও হচ্ছে তাড়াতাড়ি (ছয়টা ৩৬ মিনিটে)। তাহলে ঘড়ির এই সময় থাকার অর্থ হচ্ছে, অন্ধকার থাকতেই আমাদের ঘুম থেকে উঠতে হচ্ছে। অর্থাত্ এই সময়ে অযথা বিদ্যুত্ খরচ করছি। রাতের কাজ যেমন ছিল, তেমনই থাকছে। যারা রাত ১২টায় ঘুমাত, তারা এখন রাত একটায় ঘুমাচ্ছে। তাতে রাতের বাতি নিভছে না। স্কুল-অফিস আটটা ও নয়টায় শুরু হলে সময় একেবারেই কম। অথচ ঘড়ির কাঁটা পেছালে হাতে এক ঘণ্টা সময় বেশি থাকত।
সরকার ঘড়ির কাঁটা ফেরানোর কোনো পরিকল্পনা করছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা বলছে, মানুষ নাকি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এর চেয়ে মিথ্যা কথা আর কিছু নেই। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেই এমন কথা বলা যায়। আসলে মানুষ মনের কাঁটা আর ঘড়ির কাঁটা দুটি দিয়েই চলছে। অ্যানালগ টাইম, নাকি ডিজিটাল টাইম জিজ্ঞেস করে তবে কাজের পরিকল্পনা করতে হয়। মফস্বল শহরে সরকারি অফিস ছাড়া অন্যরা আগের নিয়মেই চলছে। আর গ্রামের জন্য সবচেয়ে বড় ঘড়ি তো সূর্য নিজেই। সেখানে দিন বড় থাকলে দিনে বেশি কাজ হয়, আর রাত বড় হলে গানবাজনা শুনে রাত কাটিয়ে দেয়। সে কারণে গ্রামগঞ্জে শীতের সময় রাতভর পালাগানের নিয়ম চলে আসছে। সারা রাত গান শুনে ভোরে ঘরে ফিরে যায়। আমাদের গ্রামগঞ্জের সংস্কৃতি মৌসুম মেনে চলে। এর সঙ্গে কৃষিকাজের বিষয়, ফসল তোলা, বৃষ্টি হওয়া না-হওয়া এবং সর্বোপরি রাতের অবসরে ভাবগান শুনে কাটানোর রীতি চলে আসছে। এখানে হাতের ঘড়ি দিয়ে জীবন নির্ধারণ করা যাবে না। পাখিগুলো তাদের নিয়ম মেনে নীড়ে ফিরে আসে, গরু-ছাগলকে সূর্য ডোবার আগে গোয়ালঘরে ঢোকায়—সাধ্য কার? সরকার শুধু মানুষ নামের এই প্রাণীকেই পারছে ইচ্ছেমতো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে আগে-পিছে ঘোরাতে।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে নারীদের। যেকোনো পরিবারে সংসারের দায়িত্ব যাঁরা পালন করেন—এমন নারীরা পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে একটু হলেও আগে ঘুম থেকে ওঠেন। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে, স্বামী অফিসে যাবেন—এই সব আয়োজন তো নারীরই। তাঁর ঘড়ির কাঁটা এমনিতেই এগিয়ে থাকে। এমন অবস্থায় সরকারের নির্দেশিত ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাঁর কাজের চাপ আরও বেড়ে যাওয়া। তিনি এক ঘণ্টা পরে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারতেন, সেটা এক ঘণ্টা আগে পাঠাতে হচ্ছে। স্বামী এক ঘণ্টা আগেই অফিসে যাওয়ার তাড়া করছেন। এই তাড়ার চাপ তাঁকেই সইতে হয়। সকাল হলে হুলস্থুল করে কাজ সেরে নিতে হচ্ছে। আর যদি এই নারী নিজেই কর্মজীবী হন, তো কথাই নেই। তাঁর ছুটোছুটি দেখে কে! তাঁর অফিসও তো এক ঘণ্টা আগেই শুরু হচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করতে হচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংসদে সাংসদেরা কেন এ বিষয় নিয়ে কথা বলেন না? বিশেষ করে মহিলা সাংসদেরা তো এই প্রশ্ন তুলতে পারেন।
গার্মেন্ট শ্রমিকেরা প্রথম থেকেই বলেছিল যে তাদের জন্য এই ব্যবস্থা সুবিধার নয়। সকাল বেলা তাদের অসম্ভব কষ্ট করতে হয়। তাদের রান্নাবান্নার কাজ সেরে তবে ফ্যাক্টরিতে যেতে হয়। রাতে এক ঘণ্টা আগে সবাই ফিরতে পারছে না, ওভারটাইম খাটছে অনেকেই। কাজেই এক ঘণ্টা ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টা বেশি খাটুনির ব্যবস্থা হয়েছে। এর বেশি আর কিছুই হয়নি। রাতে ভালো করে এক ঘণ্টা আগে ঘুমাবে, তার উপায় নেই। লোডশেডিং ঠিকই চলছে। ছোট ছোট ঘরে যারা থাকে, ফ্যান অফ হয়ে গেলে কী অসহ্য গরম হয়, তা আমাদের বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী হয়তো বুঝতেই পারবেন না। এতে ঘুমটাও ঠিকমতো কারও হয় না। আবার ঠিকই এক ঘণ্টা আগে উঠে যেতে হয়।
বিদ্যুত্ সাশ্রয়ের কথা বলে দিনের আলো সঞ্চয় করার কথা ছিল। এখন দিনের আলো কমে আসছে, সঞ্চয়ের প্রশ্ন আর নেই। রাতে বাতি এমনিতেই জ্বলবে। তবে শীতকাল এগিয়ে আসছে বলে মধ্যবিত্তদের বাড়িতে এসির ব্যবহার কমবে কিছুটা আশা করা যায়। বিদ্যুত্ যারা বেশি ব্যবহার করে, অর্থাত্ ধনীরা, তাদের বেলায় বিদ্যুত্ ব্যবহারের নিয়ম বেঁধে দিলেই হবে। সেই সাহস কি সরকারের আছে? গরিবকে কষ্ট দিয়ে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নিলে কারোরই লাভ হবে না। গ্রামের গরিব মানুষ বহু দিন আগে থেকেই জ্বালানি সাশ্রয়ের নিয়ম পালন করে আসছে। তারা কুপিবাতির তেলের খরচ বাঁচানোর জন্য রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শহরের গরিবেরা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হতে গিয়ে লোডশেডিংয়ে অভ্যস্ত হচ্ছে আর মোমবাতির ব্যবহার বাড়ছে। অথচ রাস্তাঘাটের লাইট সকাল ১০টা পর্যন্ত নেভানো হচ্ছে না। কাজেই আর বিদ্যুত্ সাশ্রয়ের দোহাই দেবেন না দয়া করে।
শেষ কথা হচ্ছে, এই নিয়মে মানুষ অভ্যস্ত হয়নি, প্রতিদিন বিরক্তি বাড়ছে। কাজেই আর দেরি নয়, ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া হোক।
ফরিদা আখতার: উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.