বিডিআর বিদ্রোহ- সেনা আইনে বিচার

গত ৩০ জুলাই ’০৯ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘আসক’ কর্তৃক ‘সরকারের সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাওয়া: আমাদের অভিমত’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমার লেখা ‘সামরিক আদালতে বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত ২২ আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কারও বা কোনো কিছুর সমালোচনা না করে শুধু সেনা আইন সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ২২ আগস্ট ’০৯ আমার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট ’০৯ আসক কর্তৃক কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে অপরাধের বিভাজন একদিকে যেমন প্রচলিত আইনি পদ্ধতির স্পষ্ট লঙ্ঘন, তেমনি অন্যদিকে তা সংবিধানের ‘আইনের চোখে সমতা’ বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে আইনের ভাষায় একমাত্র তদন্ত তথা তদন্ত প্রতিবেদনই হচ্ছে অভিযুক্ত কর্তৃক কৃত অপরাধের গুরুত্ব বা লঘুত্ব চিহ্নিত করে তাকে বিচারের জন্য প্রেরণ করার মাপকাঠি। এ ছাড়া কি অন্য কোনো পথ আছে অপরাধের গুরুত্ব পরিমাপ করার? অতএব, আইনের চোখে সমতার যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আমার ধারণা এটা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭-এর প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, অনুচ্ছেদ ২৭-এর মর্মবাণী ভিন্ন রকম। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এই মর্মে ঘোষণা করে যে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তাই অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি অনুচ্ছেদ ২৭-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আরও উল্লেখ্য, সেনা আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কখনো বিচারের সময় আসামি বলে উল্লেখ করা হয় না।
কোর্ট মার্শালে বিচার করা হলে সেখানে বিচারের আসনেও বসবেন সেনা কর্মকর্তা। সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিচারক হলে বিচারের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হওয়ার একটা আশঙ্কা সব সময়ই থাকে—উক্তিটির সত্যতা হয়তো আছে। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে আইন প্রণেতারা সংশ্লিষ্ট আইনটির অনুরূপ বিধান প্রণয়ন করেছেন সবদিক বিবেচনা করেই। বাস্তবে বিচারকের আসনে বসলে আইনের বিধানকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত ইচ্ছা/অনিচ্ছাকে আরোপ করার সুযোগ থাকে খুবই কম। সর্বোপরি উন্মুক্ত আদালতে সবকিছুই সবার নজরে থাকে। কোর্ট মার্শালের বিচার-উত্তর কার্যপ্রণালীতে এ রকম ঘটার আশঙ্কা খুবই কম। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা শৃঙ্খলা বাহিনীর আইন নিয়ে আলোচনা করছি।
সেনা আইনের ১৩৩ (আপিল বারিত)-এর বিধানটি বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের (আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার) লঙ্ঘন নয়। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। সেনা আইনের বিধান এই যে কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। এটাই তো শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য প্রচলিত আইন। তাই এ ক্ষেত্রে আপিল বারিত করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়নি। এ ছাড়া কোর্ট মার্শালে বিচারের প্রতিটি স্তরে অর্থাত্ বিচারপূর্ব, বিচার ও বিশেষ করে বিচার-পরবর্তী যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বিধান আছে, তাতে আপিলের বিধান না থাকলেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রয়াস সব স্তরেই গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে আরও উল্লেখ্য, সেনা আইনের অপরাধসমূহের বর্ণনা এতই স্পষ্ট যে কোনো সেনাসদস্য কর্তৃক কোনো অপরাধ সত্যিই সংঘটিত হলে তা আড়াল বা অস্বীকার করার সুযোগ খুবই কম থাকে। যেমন, দেশের প্রচলিত আইনে একজন অভিযুক্ত অপরাধ করেও নিঃসংকোচে আদালতে দাবি করতে পারেন যে তিনি নির্দোষ।
সেনা আইনের ধারা ১০৪ (১৪৪ নয়) ও বিধি ৩৫-এ বিধান রাখা হয়েছে যে আদালতের সদস্যদের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত ব্যক্তি আপত্তি উত্থাপন করতে পারবেন—‘একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারকের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার সাহস বাস্তবিক অর্থে করবে কি না।’ এ ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট করা যাচ্ছে যে এই আপত্তির প্রশ্নটি আদালত তার কাজ শুরু করার আগে আদালতের প্রেসিডেন্ট/জজ অ্যাডভোকেটের তরফ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিশ্লেষণ ও অভয় দিয়ে নির্ভয়ে আপত্তি তুলতে বলা হয়, অভিযুক্ত নিজে বা তার আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা/কৌঁসলির পক্ষ থেকে না তুললেও আদালতের জন্য এই কার্যক্রমটি বাধ্যতামূলক। বহু কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক আপত্তি তোলার পরও সদস্য পরিবর্তন হওয়ার পরে অভিযুক্ত ব্যক্তির সসম্মানে খালাস হয়েছে। সুতরাং অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য অনুরূপ আপত্তি ঝুঁকি বাড়ায় না।
যা হোক, গত ২৫ আগস্ট প্রথম আলোয় আসক কর্তৃক ‘সেনা আইনে নিরপেক্ষতা থাকবে কি?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সেনা আইনে বিচার পদ্ধতি দেশের প্রচলিত আইনের বিচার পদ্ধতির পরিপন্থী হিসেবে মতামত উপস্থাপন করে প্রতিবেদনে মূল চেতনায় কোন বা কী বিষয় বোঝাতে চেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। চেতনা একটি বিমূর্ত বা আদর্শগত বিষয়, অপর দিকে বিচার পদ্ধতি একটি বাস্তবসম্মত বিষয়, যা ঘটনা, সাক্ষ্য ও সাক্ষীদের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে অগ্রসর হয়।
সর্বোপরি, জনগুরুত্বপূর্ণতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলা যেখানে মুখ্য, তখন ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নসমূহের বিবেচনার স্থান হবে দ্বিতীয়।
ইবনে ফজল সাইদুজ্জামান: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.), সাবেক জজ অ্যাডভোকেট জেনারেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

No comments

Powered by Blogger.