নারীও বাংলাদেশ সালমা খান সিডওর ২৫ বছর ও নারীর মানবাধিকার

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ৩ সেপ্টেম্বর সিডও দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ কর্তৃক পুরুষের সমান পর্যায়ে নারীর মানবাধিকারের আদর্শগত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক সিডও সনদ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ পরিগৃহীত হয়, যা বর্তমানে বিশ্বের ১৮৭টি রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর কিছু ধারা সংরক্ষণ সাপেক্ষে সিডও সনদ অনুমোদন করে। সিডও সনদ পরিগৃহীত হওয়ার ২৭ বছর পর এবং বাংলাদেশের সিডও সনদে অনুমোদন দান করার প্রায় ২৫ বছর পর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নারীর মানবাধিকার বাস্তবায়ন ও অগ্রগমনে সরকারের ভূমিকা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সিডওর ২৫ বছরে বাংলাদেশের নারীর প্রাপ্যতার ঝুলি কতটুকু ভরেছে, ২৫ বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পারিবারিক, সামাজিক, সম্প্রদায়ভুক্ত ও গণজীবনে প্রকৃতপক্ষে নারীর প্রতি বৈষম্যের নিরসন হয়েছে কতখানি? বাংলাদেশের সংবিধান ২৮(১) অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিধানাবলির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব আইনকে বাতিল গণ্য করে [২৬ (১) অনুচ্ছেদ]। অন্যদিকে সিডও একটি মানবাধিকার সনদ, যা মূলত বৈষম্যহীনতা ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নারীর সব ধরনের মানবাধিকার ভোগের নৈতিক দর্শনের ওপর নির্ভরশীল এবং অনুমোদনকারী রাষ্ট্রের পক্ষে একটি আইনসম্মত আন্তর্জাতিক চুক্তি বলে বিবেচিত। তথাপি আমরা দেখি সংবিধান ও সিডও সনদের আলোকে নারীজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো, যথা উত্তরাধিকার, বিবাহ এবং সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের কোনো উদ্যোগই এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের রয়েছে সুদীর্ঘ নারী আন্দোলনের ইতিহাস। উপরন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী কাল থেকে এনজিও এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। সার্বিক মূল্যায়নে বলা যায়, বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক নারী উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি এনজিওরা নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। নারী আন্দোলনও সোচ্চার থেকে সরকারের প্রতি চাপ অব্যাহত রেখেছে নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য নিরসন করতে। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হলো, আশির দশক পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়নের মূল কৌশল হিসেবে সামাজিক উন্নয়ন অর্থাত্ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমতার ভিত্তিতে নারীর মানবাধিকার ভোগে যে বিধিনিষেধ বা সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়েছে, তা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলেও মানবাধিকার ভোগে নারীর অগ্রগতি হয়েছে ন্যূনতম।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা রয়ে গেছে অদৃশ্য, অগোচরিত এবং অনালোচিত। বৈশ্বিক পর্যায়ে নারী আন্দোলন নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনকে মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গণ্য করে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রথম ১৯৯২ সালে সিডও কমিটি কর্তৃক গৃহীত নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত ১৯ নম্বর সাধারণ সুপারিশের (জেনারেল রিকমেন্ডেশন) পরিপ্রেক্ষিতে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে নারীর সমতার অধিকারকে মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন রূপে চিহ্নিত করা হয়। পরে ১৯৯৫ সালের বেইজিং সম্মেলনে এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয় এবং নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে সর্বাত্মকভাবে নিরসনের লক্ষ্যে বেইজিং কর্মপরিকল্পনাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উন্নয়ন নীতিতে সম্পৃক্ততার পূর্বশর্ত হিসেবে সিডও সনদ বাস্তবায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করা হয়। কারণ, অনুমোদন চুক্তির শর্ত হিসেবে এই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত দায়িত্ব বর্তায় শরিক রাষ্ট্রের ওপর, যা বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় প্রযোজ্য নয়। কিন্তু সিডও সনদ অনুমোদনের দীর্ঘ ২৫ বছর পরও আমরা দেখি, সনদের পূর্ণ কার্যকারিতাকে ক্ষুণ্ন করে সনদের মৌলিক ভিত্তি ২ নম্বর ধারায় সংরক্ষণ অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং সনদে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনগত সম-অধিকার নিশ্চিত করাকে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবৃত করলেও সরকারি পর্যায়ে তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। ফলে স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও আইনের দৃষ্টিতে নারীর সমতা স্থাপিত হয়নি। নারীর শিক্ষা ও উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও পুরুষশাসিত সামাজিক অনুশাসনের মাধ্যমে নারীর অধস্তনতার বিষয়টি সামাজিক রীতি (নর্ম) হিসেবে অব্যাহত রয়েছে।
দেশে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষে জনগণের বিপুল সমর্থন গড়ে উঠলেও মৌলিক সব ইস্যু যথা লিঙ্গ-সমতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পক্ষে এখনো শক্তিশালী জনমত গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু সমাজে নতুন ধারা ও প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে নারী-পুরুষের ক্ষমতার বিভাজন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার গণ্ডি বিনির্মাণে, যা সমাজপতিদের দ্বারা নিজস্ব সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে। তাই সমাজ-নির্ধারিত তথাকথিত গণ্ডির বাইরে নারীর পদচারণের শাস্তির ভয়াবহ স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে ফতোয়া দিয়ে নারীকে দোররা মারা, একঘরে করা এবং হীনম্মন্যতার বশে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব হচ্ছে সমাজে নারী নির্যাতনের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হওয়া। প্রকাশ্যে শত শত লোকের নীরব সম্মতিতে নারীর মানবাধিকার হরণের ঘটনা ঘটে চলেছে, যার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি। এমনকি ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রশাসনিক স্পর্শকাতরতাকেও ভোঁতা করে দিচ্ছে বলে মনে হয়। যে কারণে সম্প্রতি পুলিশ প্রধান দাবি করেছেন, ‘দেশে আইন-শৃঙ্খলার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, যদিও নারী নির্যাতন বেড়েছে’ (১ সেপ্টেম্বরে সংবাদপত্র ও টিভির সংবাদ)।
নারী নির্যাতন শুধু আইন-শৃঙ্খলার অবনতির উল্লেখ্য সূচকই নয়, নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত সাংবিধানিক নিশ্চয়তা এবং সিডও বাস্তবায়নের আন্তর্জাতিক দায়িত্বেরও অংশবিশেষ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে আইনের দৃষ্টিতে এবং সামাজিক ধারণাগতভাবে নারীর ক্ষমতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার ও সিডও সনদে প্রতিফলিত মানবাধিকারের সমন্বয়ে একটি উইমেনস চার্টার বা সমন্বিত নারী মানবাধিকার নীতি প্রণয়ন করা যায়, যা রাষ্ট্রের বৈধ দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সিডও সনদের মৌলিক ধারাগুলোর সমন্বয়ে অনুরূপ উইমেনস চার্টার প্রণয়ন করেছে। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ সরকার সিডওর ধারাগুলো যথাযথ আইনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে। কারণ, সিডও নারীর মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনসম্মত একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বাস্তবায়নের মুচলেকা সরকার দিয়েছে। অঙ্গীকারমাফিক তাই আর কালক্ষেপণ না করে বাংলাদেশ সরকারকে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
সালমা খান: সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন ও উইমেন ফর উইমেনের সভাপতি।

No comments

Powered by Blogger.