জেন-জি ঝড়ে বিধ্বস্ত নেপাল by সামন হোসেন
আন্দোলনকারী তরুণরা সরকারের বিরুদ্ধে জয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক বিক্ষোভকারী অন্যদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভেতর থেকে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনতার আন্দোলনে উস্কানি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আজ আমরা ইতিমধ্যে জয়ী হয়েছি। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নিয়েছিল সরকার পতনের আন্দোলনে। আন্দোলনকারীদের দমাতে ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে সকল যোগাযোগমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের মতোই সমপ্রতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি নেতৃত্বাধীন সরকার জেন-জি’দের দমাতে ফেসবুক, ইউটিউব এবং এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফরম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। প্রতিবাদে রাজধানী কাঠমান্ডুতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন হিমালয়কন্যা খ্যাত দেশটির অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে, দেশটির সরকারি এক নোটিশে বলা হয়েছিল, ২৮শে আগস্ট থেকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে সচল সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ), ইউটিউব, এক্স, রেডিট এবং লিংকডইনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউই আবেদন জমা দেয়নি। গত বছর নেপালের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া এক নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিবন্ধনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয় দেশটির সরকার। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে দেশটিতে নিজেদের অফিস এবং একজন অভিযোগ নিষ্পত্তি ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা নিয়োগ করতে বলা হয়েছিল।
কাঠমান্ডু পোস্ট পত্রিকার সিনিয়র ফটো সাংবাদিক দীপেন শ্রেষ্ঠা বলেন, এটা নতুন কোনো আন্দোলন নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিল জেন-জিরা। তারা গতকাল সারা দেশে একযোগে এই বিক্ষোভের ডাক দেয়। সরকারও তাদের পার্লামেন্টের সামনে জায়গা দিয়েছিল বিক্ষোভ করার। বিক্ষোভকারীরা এক পর্যায়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়ে। এতেই এত হতাহত হয়। এদিকে সোমবার দুপুর থেকেই কূটনৈতিক পাড়াতে কারফিউ জারি করেছে নেপাল সরকার। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। কাঠমান্ডুর প্রধান জেলা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সোমবার দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কারফিউ কার্যকর থাকবে। প্রথমে কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর এলাকার কিছু অংশে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কারণ, আন্দোলনকারীরা সেখানে সুরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করে। পরে প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন শীতল নিবাস, মহারাজগঞ্জ, ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবন লায়নচাওর, সিংহ দরবারের চারপাশ, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বলুয়াটার এবং আশপাশ এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ চলাকালে উল্লিখিত এলাকায় চলাফেরা, সমাবেশ, বিক্ষোভ বা ঘেরাও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কারফিউর আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ট্যুরিস্ট এলাকা বলে পরিচিত থামেলের হোটেল পাড়াতে সেভাবে আন্দোলনের প্রভাব পড়েনি। এখানকার হোটেলগুলোতেই মূল নেপালে আসা ট্যুরিস্টরা অবস্থান করেন।
এদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন বল প্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নেপালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি)। বিক্ষোভ দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে তারা। সংস্থাটিও নিশ্চিত করেছে পুলিশের গুলিতে এক ডজনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। এক বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদেরও সহিংস না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এনএইচআরসি। বলেছে, নেপালের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের সহিংস হওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।
আন্দোলনের সূত্রপাত যেভাবে: স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সোমবার সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় তরুণদের নজিরবিহীন এই আন্দোলন। রাজধানীর মৈতীঘর মণ্ডলা এলাকায় জমায়েত হন বিক্ষোভকারীরা। এই এলাকাটি কাঠমান্ডুর প্রতীকী স্মৃতিস্তম্ভ এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সংযোগস্থল। মূলত এই স্থান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের ঢেউ। যা এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় দেশটির সংসদ ভবনের সামনে নিউ বাণেশ্বর এলাকায়। এই আন্দোলনের মূল কারণ সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাব এবং তরুণদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা। আন্দোলনটি সংগঠিত করে ‘হামি নেপাল’ নামের একটি যুবসংগঠন। যারা ২০১৫ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আয়ুষ বাস্যাল বলেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে দুর্নীতির যত তদন্ত হয়, তা পার্লামেন্টে আলোচনা হয়, কিন্তু কোনোটিরই সন্তোষজনক সমাধান হয় না। তা নিয়েই ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের একটি বিমান চুক্তির দুর্নীতির ঘটনা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপনের ছবি যখন টিকটকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তরুণদের ক্ষোভ চরমে ওঠে। একইসঙ্গে, সরকারের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তও এই ক্ষোভে ঘি ঢেলেছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই মন্তব্য করেন, মানুষ নিজেরাই স্বাধীন না, চিন্তাও স্বাধীন না, আবার স্বাধীনতার কথা বলছে। তার এই মন্তব্যকে আন্দোলনকারীরা অপমানজনক ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পোখারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক যোগ রাজ লামিচানে বলেন, এই আন্দোলন শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ নয়, এটি দীর্ঘদিনের অবহেলা ও তরুণদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করার প্রতিক্রিয়া। তিনি আরও বলেন, তরুণরা সুশাসন, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। তারা আর সহ্য করবে না।

No comments