ইসরাইল অপরাধের পর অপরাধ করছে: নেতানিয়াহুর হুঙ্কার, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববিবেককে কাঁপাচ্ছে
ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানায়, রবিবার সকাল থেকে ইসরাইলি হামলায় গাজায় কমপক্ষে ৫০টিরও বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে। ১০০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, বাস্তুচ্যুত পরিবারদের শিবিরের পাশের আবাসিক ভবনগুলোকে টার্গেট করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় দুই শতাধিক তাঁবু ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি জানান, তুফফাহ এলাকায় ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ উদ্ধার করা হচ্ছে। আজ-জারকা জেলায় ভবনগুলো বোমায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মসজিদ ও খেলার মাঠও হামলার শিকার। আল জাজিরার গাজার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ বলেন- একটির পর একটি সুউচ্চ টাওয়ার ভেঙে পড়তে দেখা হৃদয়বিদারক। শুধু ভবনই নয়, এগুলোর সঙ্গে জড়িত জরুরি সেবাও ধ্বংস হচ্ছে, যা মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য, বিশেষত প্রায় দুই বছরের যুদ্ধে টিকে থাকার পর।
স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শুধু সোমবারই কমপক্ষে ৫২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩২ জন নিহত হয়েছেন গাজা সিটিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আরও ছয়জন মারা গেছেন ক্ষুধা ও মারাত্মক অপুষ্টিতে। এর মধ্যে দু’জন শিশু। সোমবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ওসামা বালুশাও ছিলেন।
কর্মকর্তারা জানান, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ২৫০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তারা সবাই ফিলিস্তিনি। কারণ ইসরাইল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকতে দেয় না। এটি আধুনিক ইতিহাসে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাত। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানায়, উত্তর গাজায় একটি ট্যাঙ্কের নিচে রোডসাইড বোমা বিস্ফোরিত হলে তাদের চার সেনাও নিহত হয়েছে। সোমবার ইসরাইল নতুন উচ্ছেদ হুমকি দেয়। মানচিত্র প্রকাশ করে বলে, গাজার জামাল আবদেল নাসের স্ট্রিটের একটি ভবন ও পাশের তাঁবুগুলো খালি না করলে মৃত্যু নিশ্চিত হবে। বাসিন্দাদের তথাকথিত ‘মানবিক এলাকা’ আল-মাওয়াসিতে যেতে বলা হয়। কিন্তু আল-মাওয়াসি নিজেই বহুবার বোমা হামলার শিকার হয়েছে। বছরের শুরুতে এখানে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ অবস্থান করতো। এখন মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, সেখানে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ ঠাসাঠাসি করে অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করছে। গাজার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তারা।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেস জাতিসংঘের সমালোচনার সুরে সুর মিলিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ইসরাইলে অস্ত্র বহনকারী জাহাজ ও বিমানকে তাদের বন্দর বা আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না স্পেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মানবিক সাহায্য বাড়াবে এবং অবৈধ ইসরাইলি বসতিতে তৈরি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করবে। টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে সানচেস বলেন- আমরা আশা করি, এসব পদক্ষেপ নেতানিয়াহু সরকারকে চাপ দেবে, যাতে তারা অন্তত কিছুটা হলেও ফিলিস্তিনি জনগণের ভোগান্তি কমায়। তিনি আরও ঘোষণা দেন, যেকোনো ব্যক্তি, যিনি এই গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাকে স্পেনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে।
ওদিকে হামাস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির প্রস্তাব পাওয়ার পর তারা ‘অবিলম্বে আলোচনায় বসতে’ প্রস্তুত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, হামাসকে চুক্তি মেনে নেওয়ার জন্য এটি তার ‘শেষ সতর্কবার্তা।’
অনলাইন অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, মার্কিন পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে ইসরাইলের গাজা থেকে প্রত্যাহার অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে শর্ত হলো- গাজার নতুন সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হতে হবে। হামাস এটিকে ফাঁদ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, এই শর্ত কার্যত ইসরাইলকে পুরো নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয় যে, কবে এবং কীভাবে প্রত্যাহার হবে। সোমবার দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা একটি অবৈধ বসতির কাছে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা ও ডজনখানেক মানুষকে আহত করে। হামলাকারীদের গুলি করে হত্যা করে ইসরাইলি সেনা ও এক বেসামরিক ব্যক্তি। এর জবাবে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের মধ্যকার চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ করে দেয় এবং কাতানা, বিদ্দু, বেইত ইনান ও বেইত দুকু গ্রামে অভিযান চালায়।
আল জাজিরার হামদা সালহুত আম্মান থেকে জানিয়েছেন, এসব অভিযান আসলে ইসরাইলের ‘সমষ্টিগত শাস্তি’র নীতি। তিনি বলেন- প্রতিবার একই চিত্র দেখা যায়। গ্রামগুলোতে অভিযান চালানো হয়, রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, চেকপয়েন্টগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে, পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারটির বাড়ি ভেঙে দেয়া হয়। জেনিনে ইসরাইলি অভিযানে দু’টি ১৪ বছরের কিশোর মোহাম্মদ সারি ওমর মাসকালা এবং ইসলাম আবদেল আজিজ নোয়াহ মাজারমাহ নিহত হয়। হাসপাতাল পরিচালক উইসাম বকর জানান, জেরুজালেম হামলার কয়েক ঘণ্টা পর মাসকালা তার আঘাতে মারা যায়।
ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ মুস্তাফা বারঘুতি বলেন, ইসরাইল এ ধরনের হামলাকে সবসময় অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে। তার ভাষায়- দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামে হামলার ধারা সবসময়ই আছে, কোনো হামলা থাকুক বা না থাকুক। তারা এমন মুহূর্তকে অজুহাত বানিয়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বাড়ায়। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইসরাইলের চূড়ান্ত লক্ষ্য অপরিবর্তিত রয়েছে। তা হলো পশ্চিম তীর দখল করে নেয়া এবং এর জনসংখ্যাকে উচ্ছেদ ও জাতিগত নিধনের শিকার করা।

No comments