বদরুদ্দীন উমর: এক রাজনৈতিক কিংবদন্তির বিদায়

লেখক-গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল সকালে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। লেখক শিবির ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সঙ্গে যুক্ত মুহাম্মদ কাইউম জানিয়েছেন, বদরুদ্দীন উমরের মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে ফ্রিজিং গাড়িতে রাখা হবে। সোমবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় শহীদ মিনার বা অন্য কোনো স্থানে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ রাখা হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানটি এখনো ঠিক করা হয়নি। দুপুরে জানাজার পর জুরাইনে তার বাবা-মায়ের কবরে বদরুদ্দীন উমরের দাফন সম্পন্ন হবে। এদিকে, প্রথিতযথা এই লেখকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাশীল মানুষদের জন্য তার লেখা এবং জীবনদর্শন এক অনন্য পথনির্দেশ হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা বদরুদ্দীন উমরের শোকসন্তপ্ত পরিবার, সহকর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোক জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। শোকবার্তায় তিনি বলেন, বদরুদ্দীন উমর বারবার রাজরোষে পড়া সত্ত্বেও তিনি তার আদর্শ বাস্তবায়নে ছিলেন আপসহীনভাবে স্থির। কোনো ভীতি বা হুমকি তার কর্তব্যকর্ম থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। স্বৈরতন্ত্রকে উপেক্ষা করে তিনি তার স্বাধীন মতামত প্রকাশে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। তিনি এদেশে ছিলেন স্বাধীন বিবেকের এক প্রতীক।

তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনীতির পথিকৃৎ, লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমরের জীবনাবসানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আমি গভীরভাবে মর্মাহত। স্বাধীনচেতা, নির্ভীক কণ্ঠস্বরের এই বুদ্ধিজীবীর এই মুহূর্তে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া জনমনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। এদিকে, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে আরও অনেক উপদেষ্টা শোক জানিয়েছেন। এ ছাড়া, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
উল্লেখ্য, ১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় বদরুদ্দীন উমরের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান; যেখানে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কিন্তু তিনি কেবল একাডেমিক জীবনেই থেমে থাকেননি। ১৯৬৮ সালে গভর্নর মোনায়েম খানের কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং পরে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লেখালেখিতে নিবেদিত করেন। বিশাল কর্মভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও তার বই ও গবেষণা দেশে খুব কম আলোচিত হয়েছে। তবে, কলকাতায় তার লেখালেখি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। কাজী আবদুল ওদুদ, আনন্দশঙ্কর রায়, সমর সেন, অশোক মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা তার বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি থেকে গেছেন প্রায় অবহেলিত। ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি সংস্কৃতি পত্রিকা প্রকাশ করে এসেছেন। এর মাধ্যমে এবং তার অসংখ্য বইয়ে তিনি লিখেছেন ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, বাঙালি মুসলমানের পরিচয়, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংকট নিয়ে।

তিনি যুক্তি দিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত ভিত্তি ১৯৪৭ সালের বিভাজনের সঙ্গে শেষ হয়, পরবর্তীতে মূলত জাতীয়তাবাদকে ঘিরেই সংগ্রাম চলেছে। তার চিন্তাধারা সব সময় লোকপ্রিয় হয়নি, কিন্তু ছিল মৌলিক এবং চিন্তাজাগানিয়া। তারুণ্যে বদরুদ্দীন উমর সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে জীবনের শেষ দিকে তিনি অনেকটাই শান্ত জীবনযাপন করেছেন, বিশাল লাইব্রেরির বইয়ের সঙ্গেই কাটতো তার সময়। পড়া আর লেখা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করতেন যে, বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন অনুপস্থিত। বলতেন, এখানে সত্য কথা অবাধে বলা যায় না। তবু তিনি কখনো থেমে থাকেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নির্ভীকভাবে লিখেছেন। তার চিন্তা বুঝতে সহায়ক বিশেষ করে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯) তিনটি বই। এই বই লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি শাসকদের অধীনে চাকরি পর্যন্ত করবেন না, এ মনোভাব পোষণ করে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
বদরুদ্দীন উমর (২০ ডিসেম্বর ১৯৩১–৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
বদরুদ্দীন উমর (২০ ডিসেম্বর ১৯৩১–৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

No comments

Powered by Blogger.