তাজউদ্দীন আহমদ: রোজনামচার মানুষটিকে বোঝা by সেলিম জাহান
বইটি পড়তে শুরু করে এর বিষয়বস্তুর বাইরে পাঁচটি বিষয় আমার মনোযোগ কাড়ল। এক, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিদিনই তাঁর দিনপঞ্জিতে কিছু না কিছু লিখেছেন। এ সময়কালের মধ্যে দিনপঞ্জির কোনো পাতাই ফাঁকা যায়নি। তাঁর এই লেগে থাকার অধ্যবসায় ঈর্ষণীয় পর্যায়ের।
দুই, রোজনামচাগুলো তাজউদ্দীনের শৃঙ্খলামান্য মনের পরিচায়ক। তিনি তাঁর মনকে এমনভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিলেন যে প্রতিটি দিনের ঘটনা, তা যত সামান্যই হোক না কেন, তিনি তা রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
তিন, তাজউদ্দীন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দৈনন্দিন ঘটনাগুলো রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানে লোকজনের নামধাম, জায়গার নাম, নানা ঘটনাসহ সব খুঁটিনাটিই লিখেছেন। প্রতিটি বিষয়কেই তিনি নিবিড়ভাবে দেখেছেন এবং ব্যক্ত করেছেন। হয়তো তিনি বাস্তব অবস্থারই বর্ণনা দিতে চেয়েছেন, কোনো গল্প ফাঁদতে চাননি।
চার, রোজনামচার ভাষা এত সহজ যে পড়তে পড়তে মনে হয় যেন পাশে বসে কেউ গল্প করছেন।
পাঁচ, পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রোজনামচাগুলো ইংরেজিতে লেখা, বাংলায় নয়।
রোজনামচাভিত্তিক বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। সেই কবে কিশোর বয়সে পড়েছিলাম শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’। তবে রোজনামচাভিত্তিক বই পড়তে গিয়ে দেখেছি, এ ধরনের বইয়ের দুটো রকমফের আছে। কোনো কোনো রোজনামচা হয় তথ্যভিত্তিক; এই যেমন, কী ঘটল, কেন ঘটল এবং কেমন করে ঘটল। আমার পছন্দের নিরিখে এ জাতীয় দিনপঞ্জিগুলো বেশ নীরস এবং এগুলো আমি বড় একটা পছন্দ করি না।
অন্যদিকে কোনো কোনো রোজনামচা লেখা হয় গল্পের ভিত্তিতে। সেখানে পর্যবেক্ষণ থাকে, থাকে মানুষের মনের নানান ভাব। আমার পক্ষপাত এই দ্বিতীয় প্রকারের রোজনামচাগুলোর প্রতি। তবে বলা বাহুল্য যে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের রোজনামচাগুলো প্রথম প্রকারের। সুতরাং আমি যখন তাঁর রোজনামচার বইটি পড়তে শুরু করি, তখন প্রথম দিকে বইটির বর্ণনা আমার কাছে যান্ত্রিক, বড় শুষ্ক এবং বেশ কিছুটা নীরস মনে হয়েছে। কিন্তু অতি দ্রুতই আমি তাঁর লেখার মধ্যে ডুবে যাই। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে তাঁর লেখাগুলো শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, বরং সেগুলো তখনকার সময়, সমাজ ও রাজনীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন। তবে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, রোজনামচাগুলো এক নেতা, তাঁর চিন্তাচেতনা ও নিজস্ব বিবর্তনের জীবন্ত সাক্ষী।
এই রোজনামচা থেকে বুঝতে পারি যে জন্মভূমি আর তার মানুষদের জনাব তাজউদ্দীন আহমদ কতটা ভালোবাসতেন। রোজনামচার নানা লেখায় জনগণের জন্য তাঁর বিপুল ভালোবাসা নানাভাবে বেরিয়ে এসেছে। কখনো স্থানীয় পর্যায়ে, যেমন জন্মস্থান কাপাসিয়ার মানুষের জন্য, কখনো তাঁর রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র পুরান ঢাকার জন্য, কোনো কোনো সময় অবশ্য পুরো দেশের জন্য।
তাজউদ্দীনের লেখা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে জনগণের অধিকার, তাঁদের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তাঁদের স্বায়ত্তশাসন ও তাঁদের মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন এক অক্লান্ত কর্মী। ওই সব প্রশ্নে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অনড় এবং আপসহীন। তিনি জনগণের জন্য একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। যৌবনে যেসব দেশপ্রেমমূলক ধ্যান-ধারণা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে, সেগুলোই বহু বছর পরে যখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর প্রণীত বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁর চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাঁর রোজনামচা থেকে এটা খুব পরিষ্কার যে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বিপুলভাবে রাজনৈতিক মানুষ। রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তে রক্তে। ব্যক্তিগত কিছু বিষয় ও ঘটনার উল্লেখ ভিন্ন পুরো রোজনামচাতেই তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, চেনা-শোনা মানুষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনার বিবরণই বেশি। তাঁরা সবাই কমবেশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
মাঠপর্যায়ের সঙ্গে তাজউদ্দীনের সম্পৃক্ততা ছিল অত্যন্ত নিবিড়, ফলে স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ছিল খুবই গভীর। তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল খুবই শক্ত। তাঁর রোজনামচায় একটি লেখা আছে, যেখানে গ্রাম থেকে আসা এক ছাত্র কর্মীর সঙ্গে তিনি মুখোমুখি একটানা চার ঘণ্টা আলাপ করেছেন। রোজনামচায় তিনি লিখছেন, ‘এই আলোচনা আমাকে ঋদ্ধ করেছে।’
রাজনীতিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতায় যাওয়ার পন্থা হিসেবে দেখেননি, গণমানুষের কল্যাণের উপকরণ হিসেবে দেখেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিষয়গুলোয় তিনি সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ ও নিরাবেগ ছিলেন। পুরান ঢাকায় নানা রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনায় এ সত্য বেরিয়ে আসে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ কথাসর্বস্ব রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কিংবা তিনি বৈঠকখানার রাজনীতিবিদও ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। তাঁর রোজনামচা থেকে পরিস্ফুট যে ভাষা আন্দোলনের সময় কীভাবে তিনি আন্দোলন-কৌশলগুলো নির্ধারণ করেছিলেন, কীভাবে তিনি সরকারি যন্ত্রের মোকাবিলার করার কৌশল প্রণয়ন করেছিলেন, কীভাবে তিনি তাঁর বন্ধুদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন এবং কীভাবে তিনি নিজে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ সারা জীবন যা করেছেন, ঠিক সেভাবেই ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি গণমানুষের সঙ্গেই ছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে তিনি শুধু বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আত্মসত্তার আন্দোলন হিসেবে দেখেননি, তিনি এ আন্দোলনকে দেখেছেন বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তির সংগ্রাম হিসেবেও। রোজনামচার লেখাগুলো জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে শুধু রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে না, সেই সঙ্গে তাঁকে তাঁর পারিবারিক অঙ্গনে একজন সংবেদনশীল স্বামী, স্নেহপ্রবণ পিতা এবং একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবেও তুলে ধরে।
তাজউদ্দীন আহমদের পুরো রোজনামচায় সেই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে ফিরেছি যা তাঁর সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ কি সমাজতন্ত্রী ছিলেন?’ তাঁর রোজনামচা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু সামাজিক ন্যায্যতা, জনকল্যাণ, সাম্য ও সমতার প্রতি তাঁর দৃঢ় পক্ষপাত ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদ কি মার্ক্সবাদী ছিলেন? আমার নিজের মনে হয় যে প্রথাগত সংজ্ঞার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন না, কিন্তু চিন্তাচেতনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মার্ক্সবাদী বা কমিউনিস্ট নই, কিন্তু মার্ক্সীয় শিক্ষাকে আমি আমার জীবনধারায় অনুসরণ করি।’ জনাব তাজউদ্দীন আহমদ মার্ক্সবাদী ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তিনি অবশ্যই সমাজতন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যেসব অর্থনৈতিক নীতিমালা, কৌশল ও পরিকল্পনা অনুসৃত হয়েছিল, তার সবগুলোয় স্বাধীন ও মুক্ত বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তাধারার ছাপ ছিল।
রোজনামচাগুলো পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ইতিহাসকে অনুসরণ করেছেন, ইতিহাস তাঁকে টেনে নিয়ে যায়নি। এ প্রসঙ্গে তাঁর কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য; ‘তুমি এমনভাবে কাজ করবে যাতে তুমি ইতিহাস গড়তে পারো, কিন্তু তোমাকে যেন সেই ইতিহাসের কোথাও খুঁজে না পাওয়া যায়’।
* সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
No comments