গোপালগঞ্জের ঘটনাকে আমরা কীভাবে দেখব by এ কে এম জাকারিয়া

২০২৪ সালের জুলাই রক্তাক্ত হয়েছিল স্বৈরশাসক হাসিনার নির্দেশে। এই রক্তপাত হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়া করেছে, তিনি পালিয়ে বেঁচেছেন। গোপালগঞ্জ তাঁর নিজের জেলা, নিজের নির্বাচনী এলাকা। তাঁর বাবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। তাঁর সমাধিও সেখানে। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার বছরখানেকের মাথায় সেই গোপালগঞ্জে জনসভা করতে এসে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হলেন গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব, যাঁরা এখন তাঁদের নতুন দল এনসিপি নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগ সমর্থক হামলাকারীদের ঠেকাতে পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেগ পেতে হয়েছে। হামলাকারীরা ছিল দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও যথেষ্ট সংগঠিত। দলটির অনেক সমর্থক ও নেতা-কর্মী এনসিপিকে ঠেকাতে আশপাশের গ্রাম থেকে এসে গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নিয়েছিলেন।

তাঁরা শহরজুড়ে দফায় দফায় বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছেন, আগুন লাগিয়েছেন, ককটেল ফুটিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ ও ইউএনওর গাড়ি। শেষ পর্যন্ত চড়াও হয়েছেন এনসিপির সমাবেশে ও গাড়িবহরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুলি করতে হয়েছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনাপর্বের বর্ষপূর্তিতে গোপালগঞ্জে বুধবার যা ঘটল, তাকে আমরা কীভাবে দেখব? এই রক্তপাত কি এড়ানো যেত না? রাজনীতিতে এর প্রভাবই-বা কী?

এনসিপি ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে কর্মসূচি পালন করবে, সমাবেশ হবে—এটা আগেই ঠিক করা ছিল। বিভিন্ন জেলায় তারা ধারাবাহিকভাবে ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে সব জেলা আর গোপালগঞ্জ এক নয়, এটা আওয়ামী লীগের কবজায় থাকা একটি অঞ্চল। অনেক দেশেই রাজনৈতিক নেতাদের জন্মস্থান বা নিজের এমন এলাকা থাকে, যেখানে তাঁদের প্রতি থাকে অন্ধ সমর্থন, তা তিনি উৎপীড়ক বা স্বৈরশাসক যা-ই হন না কেন। গোপালগঞ্জের ব্যাপারটিও পুরোপুরি তা-ই।

গণ-অভ্যুত্থানের পর তার কিছু আলামত আমরা সেখানে দেখেছি। তখন সেনাবাহিনীর ওপর হামলা হয়েছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হাতে।

এনসিপির গোপালগঞ্জে কর্মসূচি ঘিরে যে হাঙ্গামা হতে পারে, তা আগে থেকেই আলোচনায় ছিল। কিন্তু পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা যে বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নেননি তা এখন প্রকাশ পাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, তাঁদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, কিন্তু এই মাত্রায় হবে, তা তাঁরা বুঝতে পারেননি। এর মানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হয় তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেনি অথবা গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গুরুত্ব বুঝতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা তার উপদেষ্টা ব্যর্থ হয়েছেন।

গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা কী করতে পারেন, তা আমাদের কারও জানা-বোঝার বাইরে নয়। এটা নানা মহলেই অনেক দিন ধরে আলোচিত যে দেশের মধ্যে ওই অঞ্চলটি এখন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পালিয়ে থাকার একটি নিরাপদ জায়গা। বিষয়টি সরকার জানে না, তা কী হয়!

এ ঘটনার দায় তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তার উপদেষ্টা এবং সেই সূত্রে সরকারের।
এনসিপির জেলায় জেলায় জুলাই পদযাত্রা নানা মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তাদের জনসমাবেশগুলোতেও লোকজনের জমায়েত বাড়ছে। যদিও কিছুদিন আগেও তাদের জমায়েতক্ষমতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

ভারতের রাজনীতিতে রীতিমতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জোগাড় হয়েছিল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর। ভারতজুড়ে তাঁর ‘ভারত জোড়ো’ নামের পদযাত্রা কর্মসূচি সেই পরিস্থিতি আমূল পাল্টে দিয়েছে। এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’ দলটির জন্য তেমনই একটি কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পদযাত্রা এমন একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি, যা জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেই কর্মসূচি যে সহিংসতার মধ্যে পড়ল, তার দায় কি কিছুটা হলেও এনসিপির নেই?

‘জুলাই পদযাত্রা’ গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে কেন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে গেল? দুই দিন ধরে এনসিপির নেতারা এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন মাঠ গরম করলেন? দেশের বাইরে থেকে গুজব ছড়ানো পতিত শক্তির জন্য আরও বেশি সুযোগ করে দিলেন না তাঁরা?

পতিত স্বৈরাচারী দলের কর্মী-সমর্থকদের মোকাবিলা ও বিরোধিতাকে একটি অঞ্চল বা জেলার বিরোধিতার দিকে ঠেলে দেওয়া কি জরুরি ছিল? ‘মুজিববাদ’ বলে যদি আদৌ কিছু থেকে থাকে, তার ‘কবর’ দেওয়ার ঘোষণা যেকোনো জেলা থেকেই দেওয়া যেতে পারে। এসব জনতুষ্টিবাদী বা মাঠ গরম করার কৌশল আর যাই হোক রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ দেয় না।

রাজনীতিতে নানা কৌশল নিতে হয়। অনেকে বলছেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এনসিপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, আলোচনায় থাকতে পারছে। আওয়ামী লীগের হামলার শিকার হয়ে তারা জন-সহানুভূতি পেয়েছে। কিন্তু কিসের বিনিময়ে?

রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের দিক থেকে উল্টোভাবে বরং এনসিপির লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। যদি এনসিপি ‘জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবেই গোপালগঞ্জ আসত, এ নিয়ে আগেভাগে কোনো মাঠ গরম না করত এবং এরপরও যদি আওয়ামী সন্ত্রাসীরা একই কাজ করত, তা হলে রাজনৈতিক লাভটি হতো আরও বেশি।

রাজনীতি একটা দীর্ঘ যাত্রা, এনসিপি সেই যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের মধ্যে একটি চরম ‘বর্তমান বিশ্বাসী’ ধারণা গেঁথে দিয়েছে। এখন বা এই মুহূর্ত ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ভবিষ্যৎ’ বলে কিছু নেই। অথচ রাজনৈতিক দলের মূল শক্তি হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ দেখতে পারার ও বিবেচনা করার সক্ষমতা। এনসিপির ‘গোপালগঞ্জ কৌশল’ প্রমাণ করে তারা সম্ভবত এই তাৎক্ষণিকতার ফাঁদে পড়েছে।  

গোপালগঞ্জের ঘটনা শুধু পাঁচটি প্রাণই কেড়ে নেয়নি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। পরাজিত ও পতিত দলটির রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের পথ তৈরি করছে। ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাও দেখছেন নাগরিক সমাজের কেউ কেউ। নির্বাচন পেছানোর পক্ষে থাকা রাজনৈতিক শক্তির কাছে অবশ্য এ ঘটনা আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ ঘটনা যে রাজনীতিতে নতুন করে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরি করতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত।

* এ কে এম জাকারিয়া, প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ই-মেইল: akmzakaria@gmail.com
- মতামত লেখকের নিজস্ব

গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা
গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। ফাইল ছবি

No comments

Powered by Blogger.