ট্রাম্প কি বিশ্বের সব ডানপন্থী নিয়ে জোট গড়তে চান by জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী দলগুলোর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক জোট হতে পারে বলে এত দিন যে কথা শোনা যাচ্ছিল, তা মূলত জল্পনাপর্যায়ের বিষয় ছিল। আগে ডানপন্থীরা নিজেদের মধ্যে যেটুকু সহযোগিতা দেখাত, তা আসলে ছিল নিজেদের প্রচারের কৌশল। সেগুলোকে সত্যিকার সহমর্মিতা বলা যাবে না। কারণ, এক দেশের ডানপন্থী নেতা অন্য দেশের কোনো মিত্র নেতার জন্য বড় কোনো ত্যাগ স্বীকার করেছেন বা তাঁদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন, এমনটি খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।

কিন্তু এখন এই চিত্র বদলাতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ সে ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ট্রাম্প সম্প্রতি ব্রাজিলের ডানপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোকে রক্ষা করার জন্য ব্রাজিলে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এটিকে তাঁর নতুন ধরনের কৌশল বলা যায়।

আরও বড় ব্যাপার হলো ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’র নামে ট্রাম্প এখন বিদেশি গণতন্ত্রগুলোর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। এটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের বড় কিছু স্বার্থ, বিশেষ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ডিরেগুলেশনের (কোনো ব্যবসা, শিল্প বা খাতে সরকার যে নিয়মকানুন বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছিল, তা কমিয়ে দেওয়া বা পুরোপুরি তুলে ফেলা) ইচ্ছাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে।

অনেকেই বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ডানপন্থা’ শব্দটা নিজেই বিরোধপূর্ণ—কারণ, প্রতিটি ডানপন্থী নেতা জাতীয়তাবাদী, তাই আন্তর্জাতিক জোট গড়া তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু এই যুক্তি ঠিক নয়। ইতিহাসে এর ব্যতিক্রম আছে। আজকের ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরাও বলছেন, তাঁরা ‘বিশ্বায়নবাদী’ ও তথাকথিত অবৈধ ‘উদার অভিজাত শ্রেণির’ বিরুদ্ধে একজোট।

এই ভাষা এবং এর সঙ্গে থাকা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (যার মধ্যে প্রায়ই অ্যান্টিসেমিটিক ভাবনা থাকে) সহজেই বিভিন্ন দেশের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। এক দেশের ডানপন্থী নেতারা অন্য দেশের নেতাদের কাছ থেকে ‘খারাপ দৃষ্টান্ত’ও শিখছেন। যেমন নাগরিক সংগঠনগুলোকে ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আইন বা গণতন্ত্র দমন করার নানা ফন্দি তাঁরা একে অপরের কাছ থেকে শিখে নিচ্ছেন।

এখনকার ডানপন্থীদের একটি আন্তর্জাতিক মতাদর্শিক কাঠামোও গড়ে উঠেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এখানে কোনো ‘পপুলিস্ট কমিনটার্ন’ নেই যে সবাইকে বাধ্যতামূলক আদর্শ দেবে কিন্তু সহযোগিতা সত্যিই হচ্ছে। যেমন ভিক্তর ওরবানের সরকার থেকে প্রচুর অর্থপুষ্ট হাঙ্গেরির কিছু ইনস্টিটিউট এখন যুক্তরাষ্ট্রের হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত ডানপন্থী নেতাদের মধ্যে প্রকৃত সহমর্মিতা দেখা যায়নি।

কিন্তু ট্রাম্প এখন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে সেই পুরোনো ধারণা বদলে দিচ্ছেন। তিনি এখন আদর্শগতভাবে অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, যা বহুদিনের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করছে। ব্রাজিলের ক্ষেত্রে তিনি ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়ে চাইছেন যেন বলসোনারোর বিরুদ্ধে চলমান ফেডারেল অপরাধের মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এই শুল্ক আরোপের চিঠিতে ট্রাম্প ব্রাজিল সরকারকে ‘আমেরিকানদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ধ্বংসাত্মক হামলা’ চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ব্রাজিলে সেন্সর করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প প্রশাসনের এই অর্থনৈতিক চাপের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিষিদ্ধ বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করা দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইউরোপীয়দের সমালোচনা করে বলেন, তারা ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার’ প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়। এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলেক্সান্দ্রে দে মোরাসকে টার্গেট করেছে। এই বিচারপতি ইলন মাস্কের এক্স প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করেছিলেন এবং বলসোনারোর বিচারিক প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব তিনিই দিচ্ছেন।

বলা চলে, বড় বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ব্রাজিলের কঠোর নিয়মকানুনে খুশি নয়। ট্রাম্পপন্থীরা এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের চাপে রাখার কৌশল নিচ্ছেন।

* জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.