পেশা যখন রাজনীতি by মহিউদ্দিন আহমদ
গ্রামে বর্ষার ছবি অন্য রকম। চাষি মুখিয়ে থাকেন বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি না হলে খেতের ফসল শুকিয়ে যায়। চাষির হাতে কলম নেই, তাঁর হাত দিয়ে পদ্য বের হয় না। তিনি কাস্তে-নিড়ানি নিয়ে মাঠে যান। নানা রকম গাছের চারা লাগান, আগাছা সাফ করেন, অথবা অলস বসে থাকেন।
শহর আর গ্রামের ছবি আলাদা। বছরখানেক ধরে শহরগুলোয় বেশ গরম। দেশে একটি বড় রকমের ওলট–পালট ঘটে গেছে। শহরে বসে তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষ সেটি জানেন টেলিভিশনের খবর দেখে। যে সূচিপত্র ধরে শহরের জীবনচক্র, গ্রামে তার দেখা মেলে না। আন্দোলন, অভ্যুত্থান, জনসভা, সেমিনার, মানববন্ধন, অবরোধ—সবই শহুরে। কয়েক দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হলে কাঁচা মরিচের দামে আগুন লাগে, শাকসবজি পাওয়া যায় না অথবা পচে যায়। নাগরিকেরা গোস্বা হন। দাম কেন বাড়ল? খাদ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই।
গ্রামে এসব নেই। তাঁরা জানেন, এ সময় শাকসবজির চাষ হয় কম। বেশি বৃষ্টি হলে সবজির খেত পানিতে তলিয়ে যায়। মরিচগাছ মরে যায়। কৃষিপণ্যের সরবরাহ যায় কমে। শহরের ভোক্তার চাহিদা কিংবা রসনা তো আর আটকে রাখা যায় না। সে ক্ষুব্ধ হয়। আমাদের দেশে গ্রিনহাউস বানিয়ে আবহাওয়াকে বশে রেখে সারা বছর সবজির চাষ হয় না। দাম তো বাড়বেই। চাষির যে অর্থনীতিজ্ঞান, শহরের ‘ফুলবাবু’দের তা নেই।
মৃত্যুরও শহর-গ্রামে রকমফের আছে। বিশেষ করে অপঘাতে মৃত্যুর। এ সময় শহরে সড়ক দুর্ঘটনা একটু বেশি হয়। বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরবাইকে ঠোক্কর লেগে রোজই মানুষ মারা যায়। গ্রামে গাড়িঘোড়া কম। সেখানে মানুষ মরে সাপের কামড়ে, পুকুরে ডুবে আর বাজ পড়ে। এখন কোভিডে ভুগে রোজই কিছু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন, কেউ কেউ মারা যান। গণমাধ্যমে তার পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। পুকুরে ডুবে কিংবা বাজ পড়ে মরে তার চেয়েও বেশি। সেসব অতটা গুরুত্বের সঙ্গে গণমাধ্যমে আসে না।
এখন তো সারা দেশেই সাংবাদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন। জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও সংবাদদাতা আছেন। তাঁরা খবর পাঠান। শহর থেকে কোন নেতা গ্রামে এসে জনসংযোগ করছেন, কর্মিসভায় ভাষণ দিচ্ছেন, কোথায় দুই গ্রামের লোকেরা দেশি অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধাচ্ছেন, সেসব খবর শহরে বসে পাওয়া যায়। শহরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আবর্জনার স্তূপ জমে। কোথাও কোথাও ডাস্টবিন আছে, কোথাও নেই। শহরের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য বাঁচাতে যাঁরা অপরিহার্য, আমরা একসময় তাঁদের মেথর বা সুইপার ইত্যাদি বলতাম। এখন আদর করে বলি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁরা ধর্মঘট করলে শহর দুই দিনের মধ্যে নরক হয়ে যায়। গ্রামে এসবের বালাই নেই।
এ তো গেল প্রকৃতির কথা। শুধু আকাশ, বাতাস, আলো, পানি নিয়ে তো আর জীবন চলে না। শহরের অলিতে গলিতে একটা জিনিসের দেখা মেলে। সেটি হচ্ছে রাজনীতি। ভাই, ইলেকশন কবে? আচ্ছা, সংস্কারের খবর কী? বিএনপির সঙ্গে কি এনসিপি সিট ভাগাভাগি করবে না কি জামায়াতের সঙ্গে যাবে? ছোট দলের বড় নেতারা বেশ ঘোড়েল। কথা বলেন মেপে মেপে। বোঝা যায় না, তঁারা এদিকে না ওদিকে। একটি বটবৃক্ষ ধরে যদি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ওই বড় দালানটায় ঢোকা যায়? বয়স তো অনেক হলো। এটিই তো শেষ সুযোগ।
গ্রামে এসব আলাপ নেই বললেই চলে। আমাদের শেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ থাকেন শহরে, ৭০ শতাংশ গ্রামে; কিন্তু দেশ চালান শহরের লোকেরা। কয়েক ঘণ্টা টানা বৃষ্টি হলে সংবাদ শিরোনাম হয় ‘বৃষ্টিতে জনদুর্ভোগ, পানিতে ডুবে গেছে রাস্তা, মওকা বুঝে রিকশা দ্বিগুণ বা তিন গুণ ভাড়া হাঁকছে, যাত্রীদের পেরেশানি’। সেই যে কবে কোন কবি লিখেছিলেন, ‘মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকি ফাটি যাওত ছাতিয়া;’ কিংবা ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ কবির তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তাঁকে তো আর ফাইল বগলদাবা করে অফিসে ছুটতে হয় না। একটা কিছু লিখে দিলেই হলো।
গ্রামের চাষা বৃষ্টি দেখে আনন্দে ভাসেন, তাঁর খেতের ফসলটা বেঁচে গেল বলে। সংস্কার, সংবিধান, শুল্ক—এসব শব্দ নিয়ে মল্লযুদ্ধ কিংবা আহাজারি নেই। তাঁরা জানেন কিংবা জানেন না, গ্রামগুলো হলো শহরের কলোনি। গ্রামের মানুষের হাড়ভাঙা খাটুনির সঞ্চয় চলে যায় শহরে। সেখানে গিয়ে সেটা লোপাট হয়, পাচার হয়ে যায় দেশের বাইরে। শহরের বাবুদের মনে আত্মপ্রসাদ—গ্রাম আর আগের গ্রাম নেই। সবার গতরে জামা আছে, পায়ে আছে স্যান্ডেল, হাতে মুঠোফোন। ধানি জমির ওপর দিয়ে রাস্তা হচ্ছে অজস্র। উন্নয়ন তো হচ্ছে।
গ্রামের লোকের আয় দুই টাকা বাড়লে শহরে বাড়ে ১০ টাকা। গ্রামের ছেলের কর্মসংস্থান হয় বাপের জমি বেচে আরব দেশে গিয়ে গতর খেটে অথবা গ্রামের রাস্তায় অটো চালিয়ে। শহরে কর্মসংস্থানের অভাব নেই। কাজ নেই? তাহলে দল করো। গায়ে রাজনীতির একটি লেবাস চাপালেই টাকা আসবে উড়ে উড়ে। ধরতে জানতে হয়। সবাই পারেন না।
একটি দলের ছাত্র, যুব, জেলে, তাঁতি কিংবা বুদ্ধিজীবী কমিটিতে একবার ঢুকতে পারলে, আর পায় কে? টাকা আসবে বানের জলের মতো। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন—ভাই, আপনার পেশা কী? কেন, রাজনীতি! রাজনীতি কীভাবে পেশা হয়, আমার বোধে আসে না। একসময় এ দেশে দু-একটি দলে কিছু সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন। দল থেকে তাঁরা ভাতা পেতেন। সে টাকা আসত বিদেশ থেকে কিংবা দেশের ভেতরে চাঁদা তুলে। চাঁদা দিতেন ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিরা। অবশ্য কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেন। তাঁদের সংখ্যা অল্প এবং এখন তাঁরা বিলীয়মান প্রজাতি।
রাজনৈতিক দলের কমিটিতে থাকলে বা ঠিকাদারি নিলে আর কোনো পেশা লাগে না। চাঁদাবাজি করেই জীবন কাটানো যায়। চাঁদা কোথায় নেই? একটি ভালো স্কুলে ছাত্র ভর্তি করালে, অফিসে কারও টেবিলে বন্দী থাকা ফাইল মুক্ত করে, হাসপাতালে বেড পেতে, অফিসে চাকরি পেতে, এমনকি দলের কমিটিতে ঢুকতেও চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া আছে আরও নানান পথ। ফুটপাতে হকার বসিয়ে কিংবা কেউ নিজে নিজে বসে গেলে তার একটি ভাড়া, গাড়িঘোড়ার ওপর খাজনা, বাড়ি বানাতে গেলে বাড়ির মালিক বা ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা। চাঁদা না দিলে পাড়ার বড় ভাই পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেয়। মেরেও ফেলে। চাঁদার বখরা নিয়ে হররোজ মারামারি, খুনাখুনি হয়।
আমরা এটার একটা জুতসই নাম পেয়েছি, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এর প্রযোজক-পরিচালক হচ্ছেন একজন গডফাদার। কোন জেলায় বা কোন শহরের গডফাদার কে, লোকমুখে আমরা তার খবর পাই। গণমাধ্যমে সবটা আসে না। এই যেমন নিকট অতীতে ছিলেন ফেনীতে জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার, খুলনায় শেখ হেলাল, বরিশালে হাসানাত আবদুল্লাহ, পুরান ঢাকায় হাজি সেলিম, রাউজানে সাকা চৌধুরী—এ রকম অগুনতি। তাঁদের হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ত না। তাঁরা রাজনীতির ফসল। রাজনীতি তাঁদের দিয়েছে দুহাত ভরে।
ক্ষমতার পালাবদল হলে গডফাদার বদলে যায়। তাদের কাজ এক, জবান আলাদা। আল্লাহ হাফেজ পার্টি, কিংবা খোদা হাফেজ পার্টি। শব্দের ব্যবহার দেখেই বোঝা যায়, কে কোন দলের। দলগুলো যদি গডফাদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিত, তাহলে এ দেশটা সোনার দেশ হয়ে যেত।
* মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
- মতামত লেখকের নিজস্ব

No comments