প্রবন্ধ- শিক্ষার বিউপনিবেশায়ন by ন্​গুগি ওয়া থিয়োং’ও এবং অনুবাদ: নূরুল কবীর

আমি লক্ষ করেছি, ১৯৮৬ সালে আমার ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড পুস্তকটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিউপনিবেশায়ন ও ভাষাগুলোর ভেতরকার অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের ব্যাপারে জগৎজুড়েই আগ্রহ বেড়েছে। কয়েক বছর আগে, ২০১৮ সালে এটিই আমাকে আয়ারল্যান্ডের মুনস্টের রাজ্যাধীন লিমেরিক শহরে টেনে নিয়ে যায়। ওই শহরে তখন ১৮৯৩ সালে স্থাপিত ‘গ্যালিক লিগ’-এর ১২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্​যাপন উপলক্ষে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

‘গ্যালিক লিগ’ খোদ আয়ারল্যান্ডে গ্যালিক বা আইরিশ ভাষার পুনরুজ্জীবনের জন্য নানা তত্পরতায় নিবেদিত একটি আইরিশ সংগঠন। আইরিশ জনগণের নিজস্ব ভাষা গ্যালিক, ইতিপূর্বে আধিপত্যশীল ইংরেজি ভাষার অধীন হয়ে পড়েছিল। পুরোদস্তুর সরকারি সমর্থনসহ নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও মর্যাদা ও প্রভাবের দিক থেকে আইরিশ ভাষা এখনো ইংরেজির অধস্তন পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে। আয়ারল্যান্ডের যত মানুষ আইরিশ ভাষায় কথা বলে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে। কতিপয় সুবিখ্যাত আইরিশ সাহিত্যিক, যেমন ডব্লিউ বি ইয়েটস ও জেমস জয়েস, ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন এবং তাঁদের সমূহ সৃষ্টি ইংরেজি সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভার হিসেবেই সর্বত্র অধীত হয়ে থাকে। ব্রিটেনসহ পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো ‘ইংরেজি বিভাগের’ কথা ভাবা যায় না, যেখানে কোর্স হিসেবে আইরিশ বংশোদ্ভূত এই লেখকদের সাহিত্যকর্ম অন্তর্ভুক্ত নয়। যেসব লেখক ইংরেজি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন, এই দুজন তাঁদের অন্যতম।

গ্যালিক ও ইংরেজি ভাষার মধ্যে বিদ্যমান অসম ক্ষমতার সম্পর্কটি, যা এখন ইংরেজির অনুকূলে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, চিরদিনই এমন ছিল না। ত্রয়োদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে, যখন ইংরেজরা আয়ারল্যান্ডে, বিশেষত তার মুনস্টের রাজ্যে বসতি স্থাপন করে, তখন ধ্রুপদি জ্ঞানচর্চার প্রশ্নে ইংরেজির চেয়ে আইরিশ ভাষা বেশি সমৃদ্ধ ছিল। স্বভাবতই আয়ারল্যান্ডে আদি বসতি স্থাপনকারী ইংরেজরা তখন তুলনামূলকভাবে বেশি প্রাণশক্তিসম্পন্ন আইরিশ ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আইরিশ ভাষার প্রতি সেই ইংরেজদের আকর্ষণ ছিল নিতান্তই বাস্তবানুগ: ইংরেজ আবাদিরা যাঁদের ভেতর বসতি স্থাপন করেছিল, তাঁদের অধিকাংশের ভাষাই ছিল আইরিশ।

এ অবস্থায় ১৩৬৬ সালে লন্ডনভিত্তিক ইংরেজ সরকার আইরিশ বা গ্যালিক ভাষার দ্রোহাত্মক গ্রাস থেকে ইংরেজিকে রক্ষা করার জন্য তত্পর হয়ে ওঠে; আয়ারল্যান্ডের কিলকেনি নগরের জন্য জারি করে ‘কিলকেনি বিধিমালা’—যার বিভিন্ন ফরমানের অধীন একদিকে বসতি স্থাপনকারী ইংরেজ–অধ্যুষিত সেই অঞ্চলে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার জোরদার করা হয়; অন্যদিকে আইরিশ ভাষার ব্যবহারকে রীতিমতো একটি ফৌজদারি অপরাধমূলক দুষ্কৃতি হিসেবে স্থির করা হয়। কিলকেনিতে বসবাসকারী কোনো ইংরেজ বা আইরিশ ব্যক্তি একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আইরিশ ভাষা ব্যবহার করলে অভিন্ন বিধিমালার অধীন তাঁদের জমি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকিও জারি রাখা হয়। ওদিকে ব্রিটিশ সরকারের এসব নীতিমালার তরফে সাহিত্যিক ও দার্শনিক ন্যায্যতা জোগানোর কাজে এগিয়ে আসেন মুনস্টের রাজ্যে বসতি গাড়া ‘দ্য ফেয়ারি কুইন’-খ্যাত ইংরেজ কবি এডমান্ড স্পেন্সার। স্পেন্সার তাঁর ১৫৯৬ সালে প্রকাশিত আ ভিউ অব দ্য প্রেজেন্ট স্টেইট অব আয়ারল্যান্ড পুস্তকে ‘যুক্তি’ প্রদর্শন করেন, ‘ভাষা ও নামকরণ পদ্ধতি হচ্ছে আইরিশ জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক স্মৃতি বিলোপ-সাধনের সর্বোত্তম উপায়।’ তিনি লেখেন, ‘বিজেতা কর্তৃক বিজিতের ভাষাকে অবজ্ঞা করা এবং বিজিতের ওপর বিজেতার ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়াই জগতের স্বাভাবিক নিয়ম।’

খোদ আয়ারল্যান্ডে আইরিশ ভাষার প্রান্তিকতাপ্রাপ্তির ঘটনাটি অবশ্য মোটেও কোনো ধরনের স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ঘটেনি, তা বরং (ইংরেজদের) সচেতন রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে সংঘটিত হয়েছে।

আয়ারল্যান্ড ছিল ইংল্যান্ডের প্রথম বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড কর্তৃক বিভিন্ন দেশের উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড একধরনের পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়ারল্যান্ডসহ তার অন্য উপনিবেশগুলোয় ইংরেজরা যেসব ব্যবস্থা প্রবর্তন ও চর্চা করেছে, পৃথিবীর অপরাপর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোও—তা হোক স্পেন, ফরাসি বা পর্তুগিজ—তাদের আপন আপন উপনিবেশগুলোয় অভিন্ন ব্যবস্থা ও চর্চা জারি রেখেছিল। জাপান কর্তৃক ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়া জবরদখলে রাখার সময়েও তা–ই ঘটেছে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রেও অভিন্ন ব্যবস্থা জারি ছিল, যেমন নরওয়ের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সে দেশের সামি জনগোষ্ঠীর ভাষার অবদমন। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের অপরাপর দেশগুলোতেও, সামান্য রকমফের সাপেক্ষে, একই ঘটনা ঘটেছে। বিজিত জনগণের ভাষার অবদমন আর বিজেতার ভাষার উচ্চতর মর্যাদা দান ও তার আধিপত্যের বিষয়টি আবার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত—যা কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয় ও জবরদখল প্রক্রিয়াকে নিষ্কণ্টক রেখে জারি থাকে।

ভাষিক অবদমন প্রকল্পটি মোটেই কোনো নন্দনতাত্ত্বিক আনন্দের জন্য গৃহীত হয়নি। স্পেন্সার খুব ভালো করেই বুঝতেন যে আইরিশ ভাষা ও নামকরণ পদ্ধতির উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটি আখেরে আইরিশ জনগণের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে, তাঁদের প্রতিরোধক্ষমতাকে দুর্বল করবে এবং তার ফলে আইরিশদের ওপর বিজয়ী আধিপত্য কায়েম করা ইংরেজদের জন্য সহজতর করে তুলবে। একটা গোটা জনগোষ্ঠীকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তার ওপর আধিপত্য জারি রাখার ব্যয় ও কার্যকারিতার তুলনায় ভাষাগত বিজয়ের মাধ্যমে সেই জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য কায়েম রাখা অনেক কম ব্যয়বহুল এবং অনেক বেশি কার্যকর। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিজয়ীকে শুধু বিজিত জনগোষ্ঠীর এলিট সমাজের মন ও মননকে অধিকার করার জন্য বিনিয়োগ করতে হয়, আর তারপর ওই এলিট গোষ্ঠী নিজেই অবশিষ্ট জনতার ভেতর অধীনতার বোধ ছড়িয়ে দেবে—বিজিত জনগোষ্ঠীর এলিট সম্প্রদায়টি বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষিক সেনাবাহিনীতে পরিণত হবে।

আধুনিক ব্রিটেনের সমৃদ্ধি ও শক্তিমত্তার পেছনে ভারত উপনিবেশের মুখ্য ভূমিকা থাকার কারণে ভারত এমনকি আয়ারল্যান্ডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছিল, যার ফলাফল পরবর্তীকালে এশিয়া ও আফ্রিকার অপরাপর উপনিবেশগুলোয় রপ্তানি করা হয়। ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র সদস্য হিসেবে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে উপনিবেশিত ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও দণ্ডবিধি প্রণয়নের মতো দুটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ প্রকল্প সম্পন্ন করেছিলেন। ম্যাকলে তাঁর ইতিহাসখ্যাত ‘মিনিটস অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’–এ, ১৮৩৫ সালে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভারতে প্রচলিত সংস্কৃত ও ফারসি ভাষাকে ইংরেজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য ওকালতি করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে তার ঘোষিত লক্ষ৵ ছিল ভারতবর্ষে এমন একটি ‘শ্রেণি’ গঠন করা, যার সদস্যরা ‘আমাদের এবং আমাদের দ্বারা শাসিত লক্ষ লক্ষ প্রজার ভেতর ভাষাগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে—যারা রক্তমাংস আর গাত্রবর্ণে ভারতীয় হলেও রুচিবোধ, মতামত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে হবে ইংরেজ’।

এ ঘটনার ঠিক ৮৭ বছর পর উপনিবেশিত কেনিয়ার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার ফিলিপ মিশেলের মুখে ম্যাকলের কথা পুনরাবৃত্ত হয়। ‘কেনিয়া ল্যান্ড’ ও তার মুক্তিকামী ‘ফ্রিডম আর্মি’র—ব্রিটিশদের ভাষায় মাউ মাউ—বিরুদ্ধে পরিচালিত ব্রিটিশ সরকারের সামরিক অভিযানকে সহযোগিতা করার জন্য মিশেল আফ্রিকার শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি প্রবর্তনের ফজিলত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিশেল বলেছিলেন, এই নতুন ভাষাশিক্ষা ‘এমন একটি সভ্য রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যেখানে জন্মগত আদি পরিচয়নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ব্রিটিশ মান ও মূল্যবোধের অধিকারী হবে, যেখানে প্রত্যেকেরই স্বার্থ নিহিত থাকবে—থাকবে অংশীদারত্ব’।

ক্যাপ্টেন রিচার্ড হেনরি প্র্যাট যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের কারলিসল অঞ্চলে তাঁর কুখ্যাত কারলিসল ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, ১৮৭৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী শিশুদের জন্য তার নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত বোর্ডিং স্কুলের পেছনে সক্রিয় শিক্ষা-দর্শন নিয়ে ১৮৯২ সালে রিচার্ড বলেন, ‘শিক্ষার্থীর বুকের ভেতরের আদি ইন্ডিয়ানটিকে হত্যা করো, আর মানুষটাকে রক্ষা করো।’ রিচার্ডের শিক্ষা কর্মসূচি এক অভিন্ন ঔপনিবেশিক বিন্যাসকেই অনুসরণ করেছে: কিছু মানুষকে তাঁদের মাতৃভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করো, ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষায় দীক্ষিত করে নতুনভাবে তাদের গড়ে তোলো, তারপর শাসিত জনগোষ্ঠীর ভেতর ছেড়ে দাও।

ওয়ালটার রোডনি তাঁর হাউ ইউরোপ আন্ডারডেভেলপড আফ্রিকা গ্রন্থে ফ্রান্সের বিভিন্ন উপনিবেশ ও তার বাইরে ফরাসি ভাষা প্রচারের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে, ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের চূড়ান্ত লক্ষ৵ সম্পর্কে, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পিয়ের ফঁস্যাঁকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘ফরাসি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের সঙ্গে তার উপনিবেশগুলোকে একটা শক্ত মনস্তাত্ত্বিক বন্ধনে আবদ্ধ করা প্রয়োজন ছিল। কারণ, যেদিন উপনিবেশগুলো তাদের প্রগতিশীল মুক্তির ভেতর দিয়ে একটি সম্ভাব্য ফেডারেশনে সংঘবদ্ধ হবে, সেদিনও তারা যেন ভাষা, চিন্তা ও চেতনার দিক থেকে ফরাসিই থেকে যায়।’

স্পষ্টতই এসব কর্মকাণ্ডের একটি পরিষ্কার লক্ষ৵ ছিল: উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর এলিট সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মন ও মননের উপনিবেশায়নই ছিল সেই সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতির লক্ষ৵। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাস্তবে সেই লক্ষ৵ পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে। উপনিবেশ–উত্তর পরিবেশে আয়ারল্যান্ডের মতো স্বাধীনতা অর্জনের পরও প্রতিটি দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ স্বদেশি ভাষার তুলনায় ঔপনিবেশিক ভাষায় নিজেদের প্রকাশ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আফ্রিকার ক্ষেত্রে মহাদেশটির এমনকি পরিচয়জ্ঞাপক বয়ানগুলোও নানা ইউরোপীয় ভঙ্গি ও ভাষায়—প্রধানত ইংরেজি, ফরাসি ও পর্তুগিজ—বর্ণিত হয়। এমনকি উপনিবেশ–উত্তর যেসব দেশের এলিট সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্ন এবং নিজেদের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর, তাঁরাও নিজেদের রাগ কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য ঔপনিবেশিক ভাষাকেই বেছে নেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভাষাশিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থের ৯০ শতাংশই নানা ঔপনিবেশিক ভাষা শিক্ষায় ব্যয় করা হয়, যদিও এসব দেশের জনগণের ৯০ শতাংশই আফ্রিকার বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করেন। আফ্রিকার কোনো কোনো সরকার, এমনকি আফ্রিকার ভাষাগুলোকে প্রগতি ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেন। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক ভাষাগুলোকেই তাঁরা বৈশ্বিক আধুনিকতার যুগে প্রবেশের সিংহদ্বার বলে বিশ্বাস করেন।

কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ কথা নিশ্চয় অদ্ভুত শোনাবে যে ফরাসি সাহিত্য কেবল জাপানি ভাষাতেই রচনা করা যেতে পারে, কিংবা ইংরেজি সাহিত্য জুলু ভাষায়—এমনি অদ্ভুত যেকোনো ফরাসি লেখকের সঙ্গে দেখা হলে আপনি তাঁর দিকে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পৃথিবীতে এত ভাষা থাকতে আপনি ফরাসি ভাষায় কেন লিখছেন?’ কিংবা একজন ইংরেজ লেখককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি জুলু ভাষায় লিখছেন না কেন?’ ইতিহাসের পরিহাস এই আফ্রিকার কিংবা অপর যেকোনো উপনিবেশ–উত্তর দেশের লেখকদের ক্ষেত্রে, এখনো, এহেন অযৌক্তিক, অদ্ভুত আর অবাস্তব প্রত্যাশা জারি রয়েছে।

এমন অদ্ভুত ও অবাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কী করে? ব্যাপারটা তো মোটেও এমন নয় যে ঔপনিবেশিক ভাষাগুলো অন্যান্য ভাষার অধিক কোনো ভাষা। যেকোনো পরিস্থিতিতে একাধিক ভাষাজ্ঞান যেকোনো ব্যক্তিকেই বিশেষভাবে ক্ষমতায়িত করে থাকে। কিন্তু উপনিবেশের ক্ষেত্রে কিংবা অনুরূপ অন্য কোনো পরিস্থিতিতে, যেখানে একটি আধিপত্যশীল ও আধিপত্যের শিকার দুটি শ্রেণি বিদ্যমান ছিল, ব্যাপারটা মোটেই এমন ইতিবাচক কিছু ছিল না। অর্থাৎ বিষয়টি কোনো উপনিবেশিত সমাজে বিদ্যমান কোনো ভাষার সঙ্গে মোটেই আরেকটি নতুন ভাষা যোগ করার মতো নিরীহ ব্যাপারমাত্র ছিল না। কেননা কোনো বিজিত সমাজে একটি নতুন ভাষা প্রবর্তন করাই বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না, বরং নিজের ভাষাটিকে উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর ভাষার কবরের ওপর চাষ করেই কেবল তাকে ক্ষান্ত হতে হতো। আফ্রিকার ভাষাগুলোর মৃত্যুই সে অঞ্চলে ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে জীবন দিয়েছে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ভাষাগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার জন্য উপনিবেশগুলোর নিজস্ব ভাষাগুলোকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। আফ্রিকার ভাষাগুলোর বিস্মৃতিই ইউরোপীয় ভাষাগুলোর জাগৃতি নিশ্চিত করেছে।

ভাষার এই দুটি অবস্থা—বিস্মৃতি ও জাগৃতি—মোটেই সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলোর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জড়িত নয়, বরং উপনিবেশিত অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সমাজের ভেতর সচেতনভাবে একটি মনোভঙ্গি তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত।

------২------

আফ্রিকার শিশুরা তাদের স্কুলে নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলে ধরা পড়ে গেলে কী ধরনের দৈহিক শাস্তির শিকার হতো, তা আমি আমার ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড গ্রন্থে আলোচনা করেছি। এ রকম ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শিশুটিকে তার ‘নির্বুদ্ধিতার’ পরিচয়জ্ঞাপক একটি প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে রাখতে বাধ্য করা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘অপরাধী’ শিশুটিকে নোংরা আবর্জনা গিলতেও বাধ্য করা হতো। এভাবে আফ্রিকার ভাষাচর্চাকে একটি অপরাধমূলক, বেদনাদায়ক, এমনকি নোংরামির সঙ্গে তুল্য তত্পরতা হিসেবে হাজির করা হতো। এ ধরনের কর্মকাল শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

ডোভার স্যামুয়েলস নামের একজন মাওরি রাজনীতিক ওয়েটাঙ্গি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ৵ দিতে গিয়ে, ২০১৫ সালে, নিউজিল্যান্ডের এক স্কুলে মাওরি ভাষায় কথা বলে ধরা পড়ে যাওয়ার পর যা ঘটত, তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীটিকে টেনেহিঁচড়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সবার সামনে নিয়ে আসা হতো...এবং তাকে শরীর বাঁকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াতে বলা হতো। তারপর, (শিক্ষক মহাশয়) তার পেছনে দাঁড়িয়ে জুতাসুদ্ধ পায়ে আধা ডজন লাথি মারত। ... এ রকম অবস্থায় আমার ঊরুর পেছন দিকটায় শুধু কালশিটেই পড়ে যেত না, অনেক সময় সেখান থেকে রক্তও বেরিয়ে আসত।’

ওদিকে নরওয়ের সামি জনগোষ্ঠী ১৮৭০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সময়টি—যে সময়কে সামিরা একটি ‘নৃশংস শতাব্দী’ হিসেবে মনে রেখেছে—এক অভিন্ন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে। নরওয়ের শাসকশ্রেণি সামি জনগোষ্ঠীকে স্বতঃস্ফূর্ত নরওয়েজিয়ান ভাষাভাষীতে পরিণত করার জন্য অভিন্ন ঔপনিবেশিক নির্মমতার চর্চা করেছে।

আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের জনগণের ভেতর, তাঁদের আপন আপন ভাষার বিপরীতে ইংরেজির চর্চা বিস্তারের জন্য ইংরেজরাও বরাবর এই অভিন্ন সহিংসতা চর্চার পথ অবলম্বন করেছে। ওয়েলসের স্কুল প্রাঙ্গণে যে শিক্ষার্থীরা ওয়েলশ ভাষায় কথা বলত, তাদের গলায় ‘ওয়েলশ নয়’ লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।

ভাষা, সংস্কৃতি ও চিন্তার ভেতর এই ‘মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন’ সৃষ্টিতে বা অন্য কথায়, মননের উপনিবেশায়নে সহিংসতাই নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। কারোর মনে হতে পারে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতালাভের পর উদ্ভূত নতুন রাষ্ট্রগুলো, নিদেনপক্ষে, পুরোনো জমানার অসম ক্ষমতা–সম্পর্কগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু উপনিবেশিত মনন এ রকম প্রত্যাশিত পদক্ষেপের প্রতিবন্ধক হিসেবে হাজির থাকে। কেননা বাস্তব জগৎকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে নিজেকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতাটি উপনিবেশিত জনগণের ভেতর ইতিপূর্বেই আত্তীকৃত হয়ে যায়।

এটা হচ্ছে কন্ডিশনিং বা বশীকরণের একটি চিরায়ত উদাহরণ, যা হামেশাই আচরণগত মনোবিজ্ঞানের নির্দেশিকায় পাওয়া যায়। বশীকরণ হলো পুরস্কার প্রদান ও শাস্তি বিধানের একটি পদ্ধতি—অবাঞ্ছিত আচরণের জন্য শাস্তি ও বাঞ্ছিত আচরণের জন্য পুরস্কার। শিশুপালনে কিংবা পশুকে বশীভূত করার জন্য প্রায়ই নানা মাত্রায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বাঞ্ছিত আচরণের সঙ্গে ‘পুরস্কার’ প্রত্যয়টি জড়িত থাকার কারণে ‘আনন্দ’ যেমন, অবাঞ্ছিত আচরণের সঙ্গে ‘শাস্তি’র প্রসঙ্গ জড়িত থাকায় ‘বেদনা’ও তেমনি এই প্রক্রিয়ার এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে জারি থাকে। বশীকরণ প্রক্রিয়ার অধীনে স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট শিশু কিংবা অন্য কোনো প্রাণী বেদনাদীর্ণ পরিসরে প্রবেশ না করার জন্য নিষিদ্ধ আচরণ চর্চা এড়িয়ে চলে এবং আনন্দময় পরিসরের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সিদ্ধ আচরণ চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়। শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষা ভালোভাবে আত্মস্থ করার জন্য কোনো শিক্ষার্থী মহিমান্বিত হয়, কিন্তু অপর নিন্দিত শিক্ষার্থীটি তার মাতৃভাষার এমনকি একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। স্পষ্টতই মাতৃভাষাচর্চার পরিসরটি শিক্ষার্থীর জন্য তখন বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে, ফলে সে তা এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে দখলদার ভাষার পরিসরটি তার জন্য আনন্দদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়, ফলে ওই ভাষাচর্চাই তার অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে।

এই বশীকরণ প্রক্রিয়ার পরিণতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভেতর একধরনের ‘পাভলভীয় চেতনা’র বিকাশ ঘটে। ফলে ‘পুরস্কার’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ামাত্রই আনন্দের আতিশয্যে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর ‘শাস্তি’ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বেদনাবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এভাবে বশীকৃত কোনো জনগোষ্ঠীর প্রথম প্রজন্মের এই আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই একটি স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে সঞ্চারিত হতে পারে—তারা হয়তো বুঝতেই পারবে না, কেন স্বদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি তার জন্য আতঙ্কজনক, আর কেনই–বা বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি তার জন্য আনন্দদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। ভাষার ক্ষেত্রে উপনিবেশ–উত্তর সমাজের এলিট সম্প্রদায় ও শিক্ষাবিদেরা ধরেই নেয় যে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ভাষাগুলো অন্তর্গতভাবেই বৈশ্বিক চরিত্রমণ্ডিত, আর বুদ্ধিবৃত্তি ও সর্বজনীনতা ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগী। এ রকম প্রচলিত অনুমান থেকেই বোঝা যায়, কেন আফ্রিকার ভাষাগুলোর দুষ্কৃতায়ন এখনো অব্যাহত রয়েছে। আফ্রিকার শিক্ষাবিদেরা তাঁদের এই আত্মঘাতী কর্মকাল সম্পর্কে নিজেরাই এখনো সচেতন নন। আফ্রিকারই কোনো সরকারের নির্দেশে আফ্রিকারই কেউ আফ্রিকান ভাষাভাষী কোনো আফ্রিকানকে এখনো শাস্তি দিয়ে চলেছে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্ট প্রাথমিক আতঙ্ক এভাবে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়। পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে এই আতঙ্ক পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করে। এভাবে অস্বাভাবিকতাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তারপর শিক্ষার বাঞ্ছিত লক্ষ৵ হিসেবে এই স্বাভাবিক অস্বাভাবিকতার জাতীয়করণ ঘটে।

মননের উপনিবেশায়ন শিক্ষার জাতিগত ক্ষমতায়নপ্রয়াসী অর্থবহ সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পথ রোধ করে দেয়। কোনো উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর ওই জনগোষ্ঠীর ওপর ঔপনিবেশিক শক্তির নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া নিহিত থাকে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিক প্রক্রিয়াকে, এমনকি জ্ঞানকেও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে দিতে পারে।

এবার আলোচনার এই পর্যায়ে, আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করা প্রয়োজন। আমাদের ইতিমধ্যেই ‘জ্ঞাত’ কিছুর সঙ্গে, নানা মানবীয় তত্পরতার পারস্পরিক প্রভাব ও প্রদীপ্তির দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নতুন কিছু নিরন্তর যুক্ত করে চলার ব্যাপারটিই হলো জ্ঞান। আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞানেন্দ্রিক প্রক্রিয়া ‘জ্ঞাত’ পরিসর থেকে যাত্রা শুরু করে ‘অজ্ঞাত’ পরিসরের দিকে অগ্রসর হয়।

প্রতিটি নতুন পদক্ষেপই কিছু ‘অজানা’কে আমাদের জানিয়ে দেয়, অর্থাৎ আমাদের ইতিমধ্যে ‘জ্ঞাত’র সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করে। এভাবেই দ্বান্দ্বিকভাবে যুক্ত পরম্পরার এক নিরন্তর অভিযাত্রায় নতুনভাবে ‘জ্ঞাত’ কিছু আমাদের ইতিপূর্বে ‘পরিজ্ঞাত’ বিষয়কে সমৃদ্ধ করে চলে। প্রত্যেকের স্থানিক অবস্থান থেকেই জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

অন্যদিকে শিক্ষা হলো কোনো বিদ্যমান সমাজে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য, সে সমাজে কর্মক্ষম থাকার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার একটি পদ্ধতি। শিক্ষার সঙ্গে ‘জ্ঞান’ বিতরণের ব্যাপারটি জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু তা হলো শিক্ষকের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে সীমাবদ্ধ জ্ঞান। একটি সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা রূপায়ণের ক্ষেত্রে, আধিপত্য ও অধীনতার, কিংবা প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্কে আবদ্ধ উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটি সতর্কভাবে পরীক্ষা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শিক্ষা কখনোই সুষম কিংবা অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না—নেতিবাচকতা থেকে পাথেয় সংগ্রহ করাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য।

ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া, বরাবরই, স্বাভাবিক জ্ঞানেন্দ্রিক প্রক্রিয়াকে নাকচ করে অগ্রসর হয়েছে। উপনিবেশিত দেশগুলোতে বরাবর ইউরোপই—ইউরোপীয় নাম, তার ভূগোল, তার ইতিহাস ও তার জ্ঞান—ঔপনিবেশিক শিক্ষার যাত্রাবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শিক্ষার উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটি বরাবরই উপনিবেশিত পরিসরে বিরাজমান জ্ঞানকে নাকচ করার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। আবার ভাষার ক্ষেত্রে, জ্ঞানের উত্স হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক অনুসন্ধানের বাহন হিসেবে শুরুতেই স্থানীয় ভাষাগুলোর উপযোগিতাকে অস্বীকার করে উপনিবেশয়ান প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। এভাবে আপন ভিত্তিভূমি থেকে মূলোত্পাটনের কারণে আপন পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, আমাদের বিভিন্ন সামর্থ্য, এমনকি আমাদের নানা অর্জন সম্পর্কেও একধরনের স্থায়ী অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি করেছে।

এ অবস্থায় যেকোনো সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার জন্য বিউপনিবেশায়ন একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার বিকল্প নেই। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, যা চার শ বছর ধরে পৃথিবীকে বর্তমানের রূপ দিয়েছে, তা পুরোনো ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশিত—উভয় প্রকার সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটি যা কিছু নাকচ করে অগ্রসর হয়েছিল, সেই সবকিছুকে নাকচ করেই কেবল বিউপনিবেশায়ন সংঘটিত হতে পারে। আমাদের স্থানিক বিন্দুতেই, অর্থাৎ আমরা যেখানে আছি, ঠিক সেখানেই আমাদের জ্ঞানের অভিজ্ঞতা শুরু হয়। আমাদের সব ভাষাই জ্ঞানের উত্স হিসেবে কার্যকর। আমরা সবাই নক্ষত্র ভালোবাসি, কিন্তু তাদের দেখার জন্য শারীরিক বা রূপকভাবে আমাদের ইউরোপে অভিপ্রয়াণের প্রয়োজন নেই।

পৃথিবীতে কিংবা যেকোনো দেশে অনেক ভাষা ও সংস্কৃতির, এমনকি অনেক ধর্মের, উপস্থিতি একটি সমস্যাজনক ব্যাপার—এই প্রচলিত অভিজ্ঞানকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। মূল সমস্যা আসলে এগুলোর ভেতর বিদ্যমান ‘মর্যাদার স্তরানুক্রমতান্ত্রিক সম্পর্কের’ মধ্যে নিহিত। আমার ভাষা তোমার ভাষার চেয়ে উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন, আমার সংস্কৃতি তোমার সংস্কৃতির চেয়ে উন্নততর, আমার ভাষা বৈশ্বিক গুণসম্পন্ন আর তোমার ভাষা নিতান্তই আঞ্চলিক, আর আমার ভাষা জানতে হলে তোমার ভাষা পরিত্যাগ করতে হবে—এমন সব ধারণাই সমস্যাজনক। আমার ঈশ্বর তোমার ঈশ্বরের চেয়ে বেশি ঐশ্বরিক—এই ধারণা নিজেই খুব অনৈশ্বরিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে অন্যের ভাষার চেয়ে নিজের ভাষার সহজাত উত্কৃষ্টতায় বিশ্বাস করতে প্রণোদিত করে—যা আবার, জ্ঞান ও ক্ষমতার মানদণ্ড, অন্যের তুলনায় নিজের উচ্চতর মর্যাদা দাবি করতে ইন্ধন জোগায়। এই প্রপঞ্চকেই আমি বলি—ভাষিক সামন্ততন্ত্র।

এই ভাষিক সামন্ততন্ত্র থেকে মুক্ত হলে সব ভাষা, ছোট কিংবা বড়, গোটা মানবসমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। সব ভাষাই ইতিহাস, সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার অমূল্য ভান্ডার—এই সত্যনিষ্ঠ প্রত্যয়ের ভিত্তিতেই যাবতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা উচিত। ভাষাগুলোর ভেতর পারস্পরিক আদান-প্রদানমূলক আন্তসম্পর্ক জারি থাকলে প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে কিছু দেওয়ার থাকে। এমনকি কোনো একটি ভাষা যদি অন্য ভাষাভাষী মানুষের ভেতর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়, সে ক্ষেত্রেও তা ওই নির্দিষ্ট ভাষাটির জাতীয়তা বা বৈশ্বিকতার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের গুণেই সংঘটিত হয়েছে—এমন কোনো অনুমিত ধারণার ভিত্তিতে গ্রাহ্য হওয়া উচিত নয়, বরং তা প্রয়োজন ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ঘটেছে বলেই বিবেচনা করা সংগত। সর্বোপরি ওই নির্দিষ্ট ভাষাটির বিকাশের জন্য অপরাপর ভাষাকে কবরস্থ করা উচিত নয়।

সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার জন্য একটি নতুন রণধ্বনি প্রয়োজন—মর্যাদার স্তরানুক্রমতন্ত্র নয়, আন্তসম্পর্ক নির্মাণ। আমাদের বোঝা প্রয়োজন যে ছোট-বড় সব ভাষারই একটি সাধারণ ভাষা আছে—অনুবাদ।

শিক্ষার তরফে কখনোই মানুষের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্ববিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত নয়। আমি জগতের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই, কিন্তু তার জন্য আমার নিজের ভিত্তিভূমিকে নাকচ করতে হবে না। আমার স্থানিক অবস্থান থেকেই আমি জগতের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। আমি মনে করি, শিক্ষার লক্ষ৵ হলো সেই জ্ঞান, যা মানুষকে তার আপন অবস্থানে রেখেই ক্ষমতায়ন করে—যা জগতের সঙ্গে আমাদের প্রকৃত যোগাযোগকে উন্মোচিত করে। আপন ভিত্তিভূমিতে অবস্থান করেই আমরা গোটা জগতের অন্বেষণ করি—সেই জগৎ থেকে এমন কিছু খুঁজে আনি, যা আমাদের ভিত্তিভূমিকে সমৃদ্ধ করে। জ্ঞানের বিন্যাস ও বিন্যস্ত জ্ঞানকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষম শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর সঞ্চারিত করার জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়নই এখন পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আমাদের যে ধারণাগুলো প্রত্যাখ্যান করতে হবে, তা হলো:

ঐশ্বর্য তো ঐশ্বর্যই নয়, যদি না তা পূতিগন্ধময় আবর্জনা থেকে স্ফুরিত হয়।

প্রাসাদ তো প্রাসাদই নয়, যদি না তা কারাগারের ওপর নির্মিত হয়।

কোটি টাকা অর্থহীন, যদি না লাখো গরিবের পকেট কেটে তা পুঞ্জীভূত হয়।

আমার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের তো বিলীন হতে হবে।

শিক্ষাকে এমন জ্ঞান সঞ্চারিত করতে হবে, যা আমাদের আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাসাদের স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য জোগায়—আমাদের একে অন্যের সত্তাকে বিকশিত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
(শেষ)

গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.