আল মাহমুদের কাব্যচিন্তা ও গ্রামে প্রত্যাবর্তনের অর্থবহতা by সুহৃদ সাদিক

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামে প্রত্যাবর্তনের আকুতি নিছক ‘আত্মজৈবনিক অনুভব’ কিংবা ‘স্মৃতিনির্ভর নস্টালজিয়া’ নয়; বরং তা এক সুগভীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। তার কবিতায় গ্রাম একটি প্রতীকী পরিসর, যা ঔপনিবেশিক আধুনিকতা ও নগরভিত্তিক পুঁজিতান্ত্রিক জীবনের কৃত্রিমতা, বিকার এবং সংস্কারমূলক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক বিকল্প জীবনচেতনা ও কৌম-সচেতনতার জোরালো অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। ‘সোনালি কাবিন’ সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে আল মাহমুদ যে গ্রামীণ জগৎ নির্মাণ করেছেন, তা কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য বা আবেগঘন স্মৃতির পুনরাবৃত্তি নয়-বরং তা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ-নির্মাণ। পাশ্চাত্যনির্ভর নাগরিক জীবনযাপনের নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও আত্মশূন্যতার বিপরীতে তিনি বপন করতে চেয়েছেন এক প্রাণময়, শেকড়-সংলগ্ন লোকায়ত জীবনের স্বপ্ন। এভাবে তার কবিতা হয়ে ওঠে এক বিকল্প কাব্যতাত্ত্বিক প্রকল্প-যেখানে ঔপনিবেশিকতার চেতনা, ঐতিহ্যনিষ্ঠ জীবনবোধ এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম একসূত্রে গাঁথা। আল মাহমুদের কাব্যচিন্তা নিছক সাহিত্যিক প্রবণতা নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষা, যা আধুনিকতাবাদের চাপিয়ে দেয়া একমাত্রিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আত্মনির্ভর, স্বদেশভিত্তিক কাব্যভুবনের দাবি তুলে ধরে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তার কবিতাকে ঔপনিবেশায়ন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদবিরোধী সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।

আল মাহমুদের সময়কাল ছিল এক গভীর সংকটের সময়-স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে একদিকে রাজনৈতিক দিশাহীনতা। অন্যদিকে ছিল সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ তথা ইউরোপকেন্দ্রিক কিংবা কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিকতার প্রাবল্য। তিরিশের কবিদের নাগরিকতা ও ইউরোপীয় নিঃসঙ্গতাবাদকে অনুসরণ করে বাংলা কাব্যে যে ভঙ্গুর, আত্মবিচ্ছিন্ন এবং নির্জীব নগরজীবনের অনুরণন তৈরি হয়েছিল, আল মাহমুদ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জোরের সঙ্গেই। শহুরে নাগরিকতার বিপরীতে তিনি ‘গ্রামে ফেরা’-এই কাব্যিক অভিপ্রায়কে রচনা করেছেন এক সাংস্কৃতিক আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রকল্প হিসেবে। তার ভাষায়: “আমি আমার কবিতায় প্রথম থেকেই গ্রামকে উত্থাপন করতে চেয়েছি... গ্রামকেই প্রাধান্য দিয়েছি; কারণ যাকে বলে ধনতান্ত্রিক নাগরিক জীবন... আমি তেমন পরিবেশে বেড়ে উঠিনি।” এই বক্তব্য কেবল জীবনবোধের ভিন্নতা নয়, এটি মূলত ঔপনিবেশিক আধুনিকতার একচেটিয়া সাংস্কৃতিক প্রতিমূর্তি বা মেট্রোপলিটন মডেলের প্রতিবাদী প্রকল্পও বটে। আল মাহমুদের কবিতায় গ্রাম কেবল একটি ‘স্থান’ নয়, এটি একটি ‘ঐতিহাসিক চেতনার ক্ষেত্র’ যেখানে লুকিয়ে আছে জাতির আত্মপরিচয়, লোকজ স্মৃতি, নৈতিক চর্চা, প্রেম, দ্বন্দ্ব এবং শৌর্যের উপাখ্যান। তিনি আধুনিকতার বয়ানে বিস্মৃত ‘সাবঅল্টার্ন’ গ্রামীণ জীবন ও লোকায়ত ঐতিহ্যকে দৃশ্যমান করে তোলেন। ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণির দৃষ্টিতে যা ‘আধুনিকতার অন্তরায়’, আল মাহমুদের কাছে তা ‘ঐতিহ্যগত শক্তি’। তার কবিতায় দেখা যায়: “কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী... কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিংবা নাড়ার দহন।” এই কবিতার চিত্রকল্পগুলো সাংস্কৃতিক আত্মোন্মোচনের গূঢ় কৌশল। এখানে কবি একটি বিকল্প জগৎ রচনা করছেন যা আধুনিক, পুঁজিবাদী ও শহুরে সংস্কৃতির বিরুদ্ধ ধারায় প্রবাহিত। ঔপনিবেশিক শক্তি কেবল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নয়, তা সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকেও সচেষ্ট থাকে। তারা স্থানিক সংস্কৃতিকে ‘লোকাচার’ বা ‘প্রাক-আধুনিক’ আখ্যা দিয়ে পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষানীতি ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক জীবনবোধ চাপিয়ে দেয়। আল মাহমুদের কবিতায় এই প্রক্রিয়ার বিপরীতে প্রবল আপত্তি পাওয়া যায়। ‘খড়ের গম্বুজ’ কিংবা ‘পলাতক’ কবিতায় তিনি দেখান নগরজীবনের অন্তঃসারশূন্যতা এবং তার কদর্যতা-যা গ্রামীণ আত্মপরিচয়ের বিপরীত।

নগরের ‘নিভাঁজ পোশাক’, ‘সেলাই’, ‘কঠিন প্যান্ট’ ইত্যাদি কবিতার চিত্রকল্পের পরতে পরতে আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিক জীবনচর্চার কৃত্রিমতা এবং দাসত্বপ্রবণতা স্পষ্ট। আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তন’ নিছক বাস্তব ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়; এটি আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিক বিশ্বদৃষ্টির একটি কাব্যিক পাল্টা আঘাত। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতায় দেখা যায় গ্রামে ফেরার জন্য কবি মোটেই লজ্জিত নন; বরং নাগরিক কৃত্রিমতা ত্যাগ করে নিজ শেকড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি আনন্দিত। তিনি লেখেন: “আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবো।”এই পঙ্ক্তিটি সাংস্কৃতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে আত্মমুক্তির প্রতীক। এই ‘ফেরার ইচ্ছা’ উপনিবেশবাদবিরোধী লেখকদের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যেখানে তারা পশ্চিমা আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির পরিবর্তে নিজেদের ভাষা, মাটি ও ঐতিহ্যে আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে সচেষ্ট হন।

আল মাহমুদের কবিতায় ‘গ্রাম’ একটি সক্রিয়, প্রতিরোধী, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কাঠামো। তিনি বলেন: “গ্রাম বলতে আমি যূথবদ্ধ আদিম মানবজীবনকে বুঝি না... ধনতান্ত্রিক নগরসভ্যতার বিরুদ্ধে গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছেন... তারা আসলে গ্রামেরই লোক।” এখানে গ্রাম প্রতিরোধের প্রতীক, এক বিপ্লবী চেতনার ঘাঁটি। এটি গভীরভাবে উপনিবেশায়নবাদী অবস্থান। ইউরোপকেন্দ্রিক বয়ানে ‘গ্রাম’ যে পশ্চাৎপদতা বা অনুন্নয়নের প্রতীক, আল মাহমুদ তা প্রত্যাখ্যান করে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার অবস্থান পুনর্গঠন করেন। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সাংস্কৃতিক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ স্থাপন করে থাকে-যেখানে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ‘নগর’-কে প্রাধান্য দেয়, আর ‘গ্রাম’-কে প্রান্তিক করে তোলে। আল মাহমুদ তার কবিতায় এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশের বিরুদ্ধে জাতিগত আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে ‘গ্রাম’, ‘লোকজ সংস্কৃতি’, ‘ভাষা’ এবং ‘ঐতিহ্য’-কে পুনঃস্থাপন করেন। তার কবিতা ‘স্বপ্নের সানুদেশে’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক স্বপ্নরাজ্য নির্মাণ করে যেখানে নগরের স্থানে গ্রাম উঠে আসে: “স্বপ্নের সানুদেশে আমরা শস্যের বীজ ছড়িয়ে দেবো...”এটি রূপক মাত্র নয়, এটি কবির সংস্কৃতিচেতনার রাজনৈতিক রূপায়ণ।

আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামে প্রত্যাবর্তনের আকুতি নস্টালজিক রোমান্টিসিজমের প্রকাশ না হয়ে একটি সুগভীর ঔপনিবেশিক কাব্যচেতনার বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠেছে। তিনি ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ছাঁচে কবিতা লেখেননি, বরং গ্রামীণ লোকজীবনের ভাষা, ছন্দ, অনুভব ও বাস্তবতার ভেতর থেকে নির্মাণ করেছেন নিজের কাব্যভাষা-যা নগরভিত্তিক আধুনিকতার কৃত্রিমতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তার কবিতায় ‘গ্রাম’ শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী অনুঘটক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ক্ষেত্র। এই লোকজ-গ্রামীণ সংস্কৃতিই তার কবিতায় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক। ফলে আল মাহমুদের কবিকণ্ঠ হয়ে উঠেছে উপনিবেশোত্তর বাংলার সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদবিরোধী সাহিত্যধারার এক বলিষ্ঠ ও স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। জীবনানন্দের প্রতীকী নিঃসঙ্গতা বা জসীমউদ্‌দীন লোকগাথার নান্দনিক অভিব্যক্তিকে ছাড়িয়ে আল মাহমুদ গ্রামকে দেখেছেন প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনায়। এই ভাবনাই তাকে আধুনিক বাংলা কবিতায় ‘লোকায়ত রাজনৈতিক কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেখানে তার কবিতা হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক মুক্তির জ্বলন্ত ও ভারবাহী ভাষ্য।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

mzamin

No comments

Powered by Blogger.