নারী-শিশু আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ by রাশিম মোল্লা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে দিনে গড়ে ১২টি মামলা হয়েছে। আগের বছরের ফেব্রুয়ারির ২৯ দিনে এই সংখ্যা ছিল একই। গত বছর সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এই আইনে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩টি। আদালতে বাড়ছে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা। ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্তাধীন ব্যতীত প্রকৃত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি। এর মধ্যে কেবল পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩২ হাজার ৯৭২টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলার সংখ্যা এক হাজার ৬০৭টি। দেশের সবচেয়ে বেশি বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ঢাকায়। ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ২১৩টি। এর মধ্যে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৫৫৬টি। আর পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন মালার সংখ্যা ৩ হাজার ১৬২টি। স্থগিত রয়েছে ২৯৩টি মামলা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। এই জেলার ৭টি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ৭৯৪টি। তদন্তাধীন ৪০৩টি এবং স্থগিত রয়েছে ২৫০টি মামলা। এর মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৫টি। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা গাজীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। এই জেলার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৬৯৫টি। তদন্তাধীন ৮০৪টি এবং ১৭টি মামলা স্থগিত রয়েছে। কেবল পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এক হাজার ২১৫টি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এতো এতো বিচারাধীন মামলার মূল কারণ হিসেবে সময় মতো মামলার বাদী ও সাক্ষীগণ সাক্ষ্য প্রদান না করাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, অঞ্চল ভেদে ঢাকার জন্য ৯টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর মধ্যে সব আদালতে বিচারাধীন মামলার চাপ নেই। নারী-শিশু ট্রাইব্যুনালে মামলার চাপ নেই বললেই চলে। মামলা বদলির সময় যেসব কোর্টে মামলা কম সেসব ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য অপেক্ষমান মামলা পাঠানো উচিত। তিনি বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং টিম গঠন করার কথা বলেন। এই টিমে পুলিশের পক্ষ থেকে একজন, প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে একজন এবং মন্ত্রণালয়ের একজনকে রাখা যেতে পারে। শুধু কমিটি করলেই হবে না প্রতি মাসে মূল্যায়ন মিটিংও করতে হবে।
দেশের আলোচিত ধর্ষণ মামলাগুলোর একটি কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুু হত্যা মামলা। আর মাত্র ১০ দিন পর শেষ হবে তনু হত্যার ৯ বছর। বিচার তো দূরের কথা এখনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই। ২০১৬ সালের ২০ মার্চে বাসা থেকে বের হওয়ার পর কুমিল্লা সেনানিবাসের জঙ্গলে তার মরদেহ পাওয়া যায়। তনুর মা-বাবা বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তনুর বড় ভাই মো. আনোয়ার হোসেন রুবেল মানবজমিনকে বলেন, আমরা আর বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী লাভ? গরিবের ওপর জুলুমের বিচার হয় না। বাবা-মা ২০শে মার্চ এলেই পাগলের মতো দিন-রাত কান্নাকাটি করেন। গত বছর পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) এর তরিকুল ইসলাম ফোন করে জানায়- তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। এখন থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।
তনুর ভাই জানান, ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে একটি বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেনি তনু। পরে স্বজনেরা খোঁজাখুঁজি করে রাতে বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতর একটি জঙ্গলে তনুর মরদেহ পায়। পরদিন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশ ও ডিবি’র পর ২০১৬ সালের ১লা এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি, কুমিল্লা। ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে ৩ জন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সর্বশেষ সন্দেহভাজন হিসেবে ৩ জনকে ২০১৭ সালের ২৫শে অক্টোবর থেকে ২৭শে অক্টোবর পর্যন্ত সিআইডি’র একটি দল ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর মধ্যে ২০২০ সালের নভেম্বরে মামলাটির দায়িত্ব পিবিআইকে দেয়া হয়। পিবিআই ঢাকার একটি টিম দায়িত্ব পাওয়ার শুরুর দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে যায়। ২০২৩ সালের ৮ই আগস্ট তনুর খালাতো বোন লাইজু জাহানের সাক্ষ্য নেয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়। নির্ধারিত সময়ে তনুর বাবা-মা ও ভাইসহ লাইজু জাহান কুমিল্লা পিবিআই কার্যালয়ে হাজির হওয়ার পর তাদের জানানো হয় তদন্ত কর্মকর্তা অসুস্থ, তাই সাক্ষ্য নেয়া যাচ্ছে না। তনু হত্যা মামলায় ৯ বছরে ৬ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। প্রথমে ২০১৬ সালের ২১শে মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলামকে। চারদিন পর তদন্তের দায়িত্ব পান কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি একেএম মনজুর আলম। একই বছরের ১লা এপ্রিল থেকে ২৩শে আগস্ট পর্যন্ত সিআইডি’র পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম মামলাটি তদন্ত করেন। ওই বছরের ২৪শে আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে সিআইডি’র নোয়াখালী ও ফেনী অঞ্চলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ২০২০ সালের ২১শে অক্টোবর হত্যা মামলাটি সিআইডি থেকে পিবিআই’র ঢাকার সদর দপ্তরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর পিবিআই তিনবার কুমিল্লায় তনুর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম ও ভাই আনোয়ার হোসেন ওরফে রুবেলের সঙ্গে কথা বলে। সর্বশেষ গত বছর পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নেতৃত্বে স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেয়ার জেরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে চরজব্বর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। গত বছরের ৫ই ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত ১০ জনের ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। মামলাটি এখন হাইকোর্টে ডেথরেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০২০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে (২০) ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় তার স্বামী বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহ্পরাণ থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দু’জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার পর আসামিরা পালিয়ে যান। তবে তিন দিনের মধ্যে ছয় আসামি ও সন্দেহভাজন দু’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র্যাব। আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করেন। আসামিদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষায় আটজন আসামির মধ্যে ছয়জনের ডিএনএ’র মিল পাওয়া যায়। ২০২০ সালের ৩রা ডিসেম্বর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পুলিশ। মামলাটি এখনো সিলেট জেলা জজ কোর্টে বিচারাধীন।
No comments