আইসিসি’র পরোয়ানায় গ্রেপ্তার রড্রিগো: আমার অপরাধ কী?

ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বিচারে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন রড্রিগো দুতের্তে। এরপর বাংলাদেশেও একই রকম নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার অধীনেও একই রকম অভিযানে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ফিলিপাইনে ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং এর আগে ডাভাও শহরের মেয়র হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালে হাজারো মানুষকে হত্যা করেছেন দুতের্তে। মাদকের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযানে ওই সময় রাজধানী ম্যানিলা ও বিভিন্ন শহর প্রায় দিনই সন্দেহজনক মাদকগ্রহণকারী বা ডিলারের রক্তে সয়লাব হতো। এর মধ্যদিয়ে দুতের্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এমন অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর ৭৯ বছর বয়সী দুতের্তেকে হংকং থেকে রাজধানী ম্যানিলায় পৌঁছামাত্র গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। তবে তিনি মাদক বিরোধী অভিযানে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চাননি। তাকে গ্রেপ্তারের পর পরোয়ানা নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করেছেন। এমনকি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন- ‘আমার অপরাধটা কী?’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে মাদকবিরোধী অভিযানে বহু মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষ হত্যায় বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন প্রায় একই রকম অবস্থানে। তবে বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কাউকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি। অনলাইন বিবিসি বলছে, রড্রিগো দুতের্তেকে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্সিয়াল মুখপাত্র সালভাদর পানেলো। তিনি এই গ্রেপ্তারকে বেআইনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ২০১৯ সালেই আইসিসি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে ফিলিপাইন। জবাবে আইসিসি বলেছে, ফিলিপাইন সদস্য দেশ হিসেবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আগে যেসব অপরাধ সেখানে সংঘটিত হয়েছে তার বিচার করার এখতিয়ার আছে আইসিসি’র। ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর হিউম্যান রাইটস ইন দ্য ফিলিপাইনস  (আইসিএইচআরপি) বলেছে, রড্রিগো দুতের্তের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেসব মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন এবং তাদের পরিবার এই গ্রেপ্তারকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। আইসিএইচআরপি’র চেয়ারম্যান পিটার মারফি বলেন, বিশ্বে নৈতিকতার পথ অনেক দীর্ঘ। এখন সেটা ন্যায়বিচারের দিকে বেঁকে গেছে। তার নৃশংস শাসনকে সংজ্ঞায়িত করে যে গণহত্যা তার জবাবদিহিতা শুরু হচ্ছে দুতের্তেকে গ্রেপ্তারের মধ্যদিয়ে। উল্লেখ্য, আগামী ১২ই মে দেশটিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন। এর জন্য হংকং থেকে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। ডাভাও শহরের মেয়র পদে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছিলেন। স্থানীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজে দেখা যায়, বিমানবন্দরে একটি লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসছেন দুতের্তে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছে, তিনি সুস্থ আছেন। সরকারি চিকিৎসকরা তার দেখভাল করছেন। হংকং ত্যাগ করার আগে তাকে দেখতে ফিলিপাইনের বেশ কিছু প্রবাসী জড়ো হন। তারা উল্লাস করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তাদের উদ্দেশ্যে দুতের্তে বলেন- আমার অপরাধ কী? ফিলিপাইনের জনগণের শান্তি ও শান্তিময় জীবনের জন্য আমার ক্ষমতার সময়ে সবকিছুই করেছি। তার মেয়ে ভেরোনিকা দুতের্তে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাতে দেখা যায়, ম্যানিলার ভিলামোর বিমান ঘাঁটিতে একটি লাউঞ্জে নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন দুতের্তে। সেখান থেকেও তাকে কি কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শোনা যায়। তিনি বলেন, কোন অপরাধ আমি করেছি? আমাকে নিজের ইচ্ছায় নয়, অন্য কারও ইচ্ছায় আনা হয়েছে এখানে। স্বাধীনতা হরণ করার জন্য এখন আপনাদেরকেই জবাব দিতে হবে। ফিলিপাইনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচার্ড হেডারিয়ান বলেন, দুতের্তেকে গ্রেপ্তারের মধ্যদিয়ে ফিলিপাইনের ইতিহাসে নতুন একটি যুগের সূচনা হচ্ছে। এটা হলো আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বিষয়। হেডারিয়ান বলেন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে স্থানীয় আদালতে বিষয়টিকে বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দরে দুতের্তেকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করেছে।

দুতের্তে এবং মারকোস পরিবার ২০২২ সালের নির্বাচনে একটি জোট গঠন করেছিল। সে সময় প্রেসিডেন্ট পদ না চেয়ে মারকোস জুনিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করুন মেয়ে সারা দুতের্তে- এমনটাই চেয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতের্তে। কিন্তু রাজনৈতিক আলাদা এজেন্ডা সামনে আসায় কয়েক মাস ধরে এই দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথমদিকে আইসিসি’র তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান প্রেসিডেন্ট মারকোস। কিন্তু দুতের্তে পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হতেই থাকে। ফলে প্রেসিডেন্ট মারকোস তার অবস্থান বদলান। পরে ইঙ্গিত দেন- আইসিসিকে সহযোগিতা করবে ফিলিপাইন। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুতের্তেকে দ্য হেগে অবস্থিত আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রেসিডেন্ট মারকোস পাঠাবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য, ২২ বছর ধরে দেশটির দক্ষিণে বিস্তৃত ডাভাও শহরের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দুতের্তে। ওই সময়ে রাজপথের অপরাধ একেবারেই কমে গিয়েছিল।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.