মোহাম্মদপুরে সিরিজ ছিনতাই, আতঙ্ক by সুদীপ অধিকারী

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই অস্থির রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা। রাতে গণছিনতাইয়ের পাশাপাশি দিনের আলোতেও ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পথচারীদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ছাড় পাচ্ছেন না নারীরাও। চলন্ত গাড়ি ঠেকিয়ে অস্ত্রের মুখে লুটে নেয়া হয়েছে কোম্পানির লাখ লাখ টাকা। স্থানীয় মুদি দোকানের ভিতর ঢুকেও টাকা লুটে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। দিনে-রাতের এসব কর্মকাণ্ডে বসিলা, ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, বসিলা গার্ডেন সিটি, ৪০ ফিট, নবোদয় হাউজিংসহ এক আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকা।

সম্প্রতি এমনই ছিনতাইয়ের কবলে পড়া নারীর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটিতে  দেখা যায়,  কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারী। কালো রঙের হাফ প্যান্ট ও কালো শার্ট পড়া এক কিশোর দৌড়াতে দৌড়াতে তার মাজা থেকে ধারালো ছুরি বের করে ওই নারীর পথরোধ করে। পেছন থেকে আরও ৪ কিশোর নারীকে ঘিরে ধরে। তাদের মধ্যে কালো হাফ প্যান্ট-কালো গেঞ্জি পরা এক কিশোর হাতে বিশাল ছ্যান দাঁ নিয়ে মেয়েটির ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে। চার-পাঁচ জন মিলে অস্ত্র নিয়ে ঘিরে ধরার পরও নারীটি তার  ব্যাগ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে কালো শার্ট পরা ছেলেটি নারীর ওড়না ও ব্যাগ ধরে সজোরে টান দেয়। আরেকজন কোপ দেয়ার ভয় দেখায়। ইজ্জত ঢাকার ওড়না ও ব্যাগ নিয়ে নেয়ার পর নিজের জীবন বাঁচাতে একপর্যায়ে দৌড়ে স্থান ত্যাগ করেন ওই নারী।

ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিও’র ঘটনাটি গত ২১শে অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মোহাম্মদপুর থানার নবোদয় হাউজিং এলাকার ডি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের রোজ গার্ডেন নামের একটি ভবনের সামনে ঘটেছে। নিজের বাসার পাশেই সেদিন ভয়ঙ্কর ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন ওই নারী। নাম প্রকাশে অনিচ্চুক ওই নারী ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি দোহারে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোহাম্মদপুরে খালার বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য সেদিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হই। বাসার গেটের বাইরে বের হতেই কয়েকজন হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে পেছন দিক থেকে এসে আমাকে ঘিরে ধরে। একপর্যায়ে ব্যাগ ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে। ব্যাগ দিতে না চাইলে তারা বড় বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাকে কোপ দিতে যায়। আমি তখন ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই আমার ব্যাগ ছাড়িনি। তারা বার বার বলছিল-ব্যাগ দিয়ে দে না হলে কোপ দেবো। এর মধ্যে একজন আমার গায়ের ওড়না ধরে টান দেয়। তখন ওড়নার সঙ্গে ব্যাগও রাস্তায় পড়ে যায়। আমি জীবন বাঁচাতে তখন বাসার দিকে দৌড় দেই। ওইদিনের ঘটনা আমি কখনো ভুলবো না। ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর বড় বোন জান্নাতুল সুরভী বলেন, আমার বোন সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ছিনতাইকারীরা যেভাবে হামলা করেছে তাতে তার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারতো। ওর ব্যাগে মোবাইল, টাকা, আইডিকার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্র ছিল সব নিয়ে গেছে। ওর বুকের ওড়নাটা পর্যন্ত টান দিয়ে খুলে ফেলা হয়েছে। ওই ঘটনায় আমার বোন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। সেদিনের পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সেদিন ওই শিক্ষার্থীকে অস্ত্র হাতে প্রথম গতিরোধ করে রতন। এরপর তার সঙ্গে যোগ দেয় নবোদয় হাউজিং বাজারের পাশের বস্তির শাওন, লিটকি, ইব্রাহিম (ইবু) ও শেখেরটেকের ফয়সাল। শুধু ওই নারীর কাছ থেকে ছিনতাই নয় মোহাম্মদপুর এলাকার আরও বেশ কয়েকটি ছিনতাই ও কুপিয়ে জখমের ঘটনায়ও তারা জড়িত।

এর আগের দিন ২০শে অক্টোবর সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দিনে-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকিয়ে অস্ত্রের মুখে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় ৬ দুর্বৃত্ত। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নেসলে’র মোহাম্মদপুরের এরিয়া অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সেদিন সকাল ৯টার দিকে কোম্পানির টাকা ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য গাড়িতে করে অফিস থেকে বের হই। যখন আমরা মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় পৌঁছাই তখন রাস্তা ভাঙার কারণে আমাদের গাড়িটি কিছুটা ধীরগতিতে চলছিল। এরমধ্যে পেছন থেকে দু’টি মোটরসাইকেলে করে মোট ৬ জন ছিনতাইকারী এসে আমাদের গাড়ির লুকিং গ্লাস ভাঙচুর করে। এরপর তারা মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের গাড়ির সামনে চলে আসে। আমরা গাড়ি থামালে তারা চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র নিয়ে গাড়ির সামনের গ্লাস ভাঙচুর শুরু করে এবং আমাদের কোপ দিতে যায়। তাদের কোপে আমি পড়ে গেলে তারা টাকার ব্যাগ নিয়ে নেয়। যাওয়ার সময় আমার পকেটে টাকা, মোবাইল যা ছিল তাও নিয়ে যায়। সাইফুল ইসলাম বলেন, সেদিন আমাদের কাছে থাকা ওই ব্যাগে অফিসের ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ১৭ হাজার টাকার একটি চেক ছিল। সম্পূর্ণ টাকা ও চেক নিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।

১৯শে অক্টোবর বেলা সাড়ে ৩টায় বসিলা ৪০ ফিট সড়কে ছিনতাইয়ের শিকার হন খন্দকার রাফি ও তার সঙ্গে একই বাসায় থাকা আরও দুইজন। রাফি বলেন, সেদিন আমরা তিনজন রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে হেঁটে বাসায় আসছিলাম। হঠাৎ করে পেছন থেকে ৯/১০ জন অল্প বয়সী ছেলে আমাদেরকে ঘিরে ধরে। তাদের সকলের হাতেই বড় বড় ধারালো অস্ত্র ছিল। তারা আমাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিয়ে চলে যায়। অস্ত্রের ভয়ে কিছুই বলার সাহস পাইনি তখন। মোহাম্মদপুরে একের পর এক খুন, ছিনতাইয়ের ঘটনা যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে।

মোহাম্মদপুরের ছিনতাইয়ের আরেকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কিছু লোক একটি মুদি দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্রের মুখে দোকানিকে জিম্মি করে ক্যাশ বাক্সের সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটি গত ২৪শে অক্টোবর মোহাম্মদপুর বসিলা ৪০ ফিট এলাকার। দোকানি জানান, আমি দোকানে বসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এর মধ্যে আমার একটি ফোন কল আসে। ওই কল রিসিভ করতেই কয়েকজন যুবক মুখে মাস্ক পরে ধারালো অস্ত্র হাতে নিয়ে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমাকে মারধর করে দোকানের ক্যাশ বাক্স থেকে সব টাকা নিয়ে চলে যায়। জীবন বাঁচানোর ভয়ে সেদিন কিছুই বলতে পারিনি। অপরদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত মোহাম্মদপুর এলাকায় অন্তত ৭ জনকে খুন করা হয়েছে। এর মধ্যে গুলিতে, ছুরিকাঘাতে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আছে। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, এলাকায় প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি চোর ধরতে গিয়েও ছুরিকাঘাতে রবিউল ইসলাম নামের ঢাকা উদ্যানের এক নৈশপ্রহরীকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গতকাল বিকালে থানায় গিয়েছেন এলাকাটির সাধারণ ছাত্র-জনতা।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, গত কয়েকদিন মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ভিডিওগুলো দেখে আমি ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছি। কিন্তু তারা কোনো অভিযোগ বা মামলা দিতে চান না। তারপরও আমরা জড়িতদের শনাক্তে কাজ করছি। তিনি বলেন, আমার লোকবল কম। আমি দিনে ৪-৫ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারি না। বাকি সময়ের বেশিরভাগটা রাস্তাতেই কেটে যায়। আমাদের প্রত্যেকের ওয়ার্কিং আওয়ার বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। আমরা প্রতিরোধমূলক সব রকম ব্যবস্থাই নিচ্ছি। টহল জোরদার করা হচ্ছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.