গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইরানবাসী। কিছুক্ষণ পরই মসজিদে মসজিদে ফজরের আযান হবে। কিন্তু তার আগেই আকস্মিক ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ। কেঁপে ওঠে পুরো তেহরান, খুজেস্তান, কারাজ শহর। এসব স্থানে কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রায় ২০টি সামরিক স্থাপনায় ইসরাইল হামলা করেছে। ইরানের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে এই হামলা। এতে বিকট শব্দে, অগ্নিশিখায় আলোকিত হয়ে ওঠে আকাশ। আকস্মিক ঘুম ভেঙে হকচকিয়ে যান সাধারণ মানুষ। মায়ের কোলে কেঁদে ওঠে শিশু। ততক্ষণে ইসরাইলের হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের দু’জন সেনা সদস্য। ইসরাইল ঘোষণা দিয়েছে, এর আগে তেল আবিবে ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল, তার জবাবে এই হামলা। তাদের এই পাল্টা জবাব সম্পন্ন হয়েছে। ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, যদি এরপরও ইরান প্রতিশোধ নিতে হামলা চালায়, তাহলে জবাব দিতে বাধ্য থাকবে ইসরাইল। কিন্তু ইরান সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারাও সর্বশেষ এই আগ্রাসী হামলার জবাব দিতে প্রস্তুত। এমন হামলা-পাল্টা হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববাসী। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানিয়ে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে ইরানের প্রতি পাল্টা হামলা না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন। তারা বলেছে, এতে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়বে। বাড়বে অস্থিতিশীলতা। কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে আরও বড় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল- জাজিরা, বিবিসি বলছে, ‘ইরানের ড্রোন হামলা ও তার প্রক্সি যুদ্ধের’ জবাবে ইসরাইল এই হামলা চালিয়েছে। রাজধানী তেহরানের চারপাশে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের মিডিয়াগুলো বলছে, অভিজাত ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কোনো সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়নি। কারণ, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে। পরে অবশ্য হামলার কথা স্বীকার করে ইরান। হামলার পর ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। ওদিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইরাক তার সব বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক স্থগিত করেছে। পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক সামরিক অপারেশনের মধ্যে দেশের আকাশসীমা তারা বন্ধ রাখছে। বিবিসি বলছে, ইরানের সামরিক টার্গেটগুলোতে যথার্থ হামলা চালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরাইল। তবে ঠিক কোন কোন স্থাপনায় হামলা হয়েছে এবং তাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। এর আগে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং তেল ক্ষেত্রগুলোতে হামলা না চালাতে ইসরাইলকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মতে, যদি এসব স্থাপনায় হামলা হয়, তাহলে পুরো অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, দামেস্কে ইরানের কন্স্যুলেটে হামলার জবাবে ইরান এ মাসের শুরুর দিকে ইসরাইলে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইসরাইলের দাবি, সেই হামলার জবাবে তারা শনিবার ভোররাতে এই হামলা চালিয়েছে। উল্লেখ্য, এমনিতেই গাজা, পশ্চিমতীর, লেবানন নিয়ে অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য। এরই মধ্যে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ে, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ এবং আইআরজিসি কুদ্স ফোর্সের অপারেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস নিলফোরুশানকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এসব হত্যার মধ্যদিয়ে তারা ওই বাহিনীগুলোকে অনেকটা দুর্বল করে দিয়ে, তবেই ইরানে হামলা চালিয়েছে। বিবিসি বলছে, ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোর দাবি ইসরাইলের হামলা ব্যর্থ হয়েছে। এমন দাবি ইরান বরাবরই করে আসছে। কিন্তু যদি এবারের হামলায় বড় কোনো ক্ষতি হয় বা মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, তাহলে সেই বর্ণনা পাল্টে যাবে। ওদিকে সিরিয়ায়ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এসব হামলার দায় ইসরাইল স্বীকার করেনি। সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী বেশকিছু ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশে নিষ্ক্রিয় করেছে এবং গুলি করে তাদের ভূপাতিত করেছে। পেন্টাগনের সর্বশেষ তথ্যমতে, ইরানে সর্বশেষ এই হামলায় যুক্ত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস এ হামলাকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার চেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে।
জবাব দিতে প্রস্তুত ইরান: গাজা, পশ্চিমতীর, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক- সর্বত্রই উত্তেজনার আগুন। তার মধ্যে শনিবার ভোরে প্রতিশোধ নিতে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তবে ইরানও কঠোর বার্তা দিয়েছে। তারা বলেছে, উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। ফলে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ উপরে উঠছে। ইসরাইলকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও তেলক্ষেত্রকে এড়িয়ে হামলা চালাতে। আগ্রাসী এই হামলার জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ইরান। মিত্র হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলার প্রতিশোধ নিতে চার সপ্তাহ আগে অভিযান চালায় ইরান। সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে উপযুক্ত সময় খুঁজছিল ইসরাইল। এরই মধ্যে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হামাস, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছে ইসরাইল। এর মধ্য দিয়ে তারা এসব সংগঠনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এরপরই ইরানের ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে শনিবার ভোরে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তেজনা কখনো বিদায় নেয়নি। এখন ইসরাইলের হামলার জবাবে ইরানও প্রস্তুত। ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জবাব দিতে তারা প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। সূত্রের উল্লেখ করে এসব তথ্য দিয়েছে আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম। এতে বলা হয়, ইসরাইল উপযুক্ত জবাব পাবে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে নতুন করে যদি কোনো উত্তেজনা বৃদ্ধি করে তাহলে কড়া মূল্য দিতে হবে বলে ইরানকে সতর্ক করেছে ইসরাইল।
ইরানে সব ফ্লাইট বাতিল: হামলার জবাবে আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে ইরান। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা বলেছে, ইসরাইলের হামলার কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেন ইরানি স্পিকার: নৃশংসতা চালাতে ইসরাইলকে ভয়াবহ সব অস্ত্র সরবরাহ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের কালিবাফ। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র দিয়ে জায়নবাদী ইসরাইল নৃশংসতা চালাচ্ছে। শুক্রবার সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাসিজ শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। বলেন, বর্তমানে আমরা যেসব অপরাধ দেখছি তা ইসরাইল অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের এর আগে দেয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। এর মাধ্যমেই তারা গণহত্যা করছে এবং বিভিন্ন নেতাকে হত্যা করছে।
No comments