সিজিএস’র সংলাপ: সব সংস্কারে হাত দিলে সফলতা আসবে না
‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ’ এর সিরিজ আয়োজনে গতকালের আলোচনার বিষয় ছিল ‘অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস (বিস) মিলনায়তনে আয়োজিত সংলাপে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সকলেই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। আমরা উপরিকাঠামো নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না। ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, গার্মেন্টকর্মীদের স্যালারি কতো হবে এসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়। মাত্র তিন মাস আগে এই সরকার এসেছে। গত বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা ছেদ হয়েছে। যার কারণে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আলোচনা হওয়া উচিত নীতিগুলোই তো দেড় দশক ধরে আলোচনা করে আসছি। কেন বাস্তবায়ন হলো না? তাদের কাছে প্রশ্ন, কেন আপনারা বাস্তবায়ন করতে পারলেন না? রাজনীতিবিদরা এখন ব্যবসায়ী আর আমলারা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। বিগত শাসনামলে জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি, খানা জরিপ, রপ্তানি আয়ের ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করেছে স্বার্থগোষ্ঠীর মাধ্যমে। সামান্য একটা চুরির ঘটনাতেও এলাকার নেতার অনুমতি ছাড়া মামলা হতো না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স পেতো না। তারা অনেক উন্নয়নের কথা বলে টাকা ছাপিয়ে দিলো। ওনার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কোনো নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল না, জবাবদিহিতা ছিল না। এরকম একটা ব্যবস্থার পর নতুন একটা সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। রাতারাতি পরিবর্তন তো আসবে না।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বেশকিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। এখনো সুফল না এলেও হয়তো সামনে আসবে। বর্তমান সরকারের দুইটা ধারা। একটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এই সংস্কারের জন্য কমিশন হচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। সেই নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছি। ইসি’র জন্য শিগগিরই কোনো একটা সার্চ কমিটি হবে। কিন্তু এর বাইরে রয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো। আমাদের অনুধাবন করার বিষয় হলো ওপরের দুইটি ধারার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কী, সেটার জন্য আমাদের সংস্কার প্রয়োজন।
সংলাপে সঞ্চালনা করেন সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি সূচনা বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে সংস্কার শব্দটা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। ২০০৭/০৮ সালেও সংস্কার শব্দটা ব্যাপক আলোচনা হলো। এমন একটা সময় এলো সংস্কার শব্দটা ঘৃণিত হলো। ২৪’এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করলাম। অনেকেই বলেন এটাকে বিপ্লবী সরকার, আমি এটাকে বিপ্লবী সরকার বলবো না। আবার অনেকেই বলেন, আমি সংবিধান মানি না। কিন্তু তারাই আবার সংবিধানের মধ্য থেকে শপথ নিলেন। আমরা পরিবর্তন চেয়েছি। বিগত সরকারের সময়ে অনেকে ক্যামেরার সামনে বাহবা দিলেও ক্যামেরার বাইরে হতাশার কথা বলেছেন। একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। লুটপাটের কথা আমরা শুনেছি। অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়েও বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। আবার দেশের টাকা দেশেও নাই। ছাত্র-জনতার হাজারো মানুষের রক্ত দিয়ে নতুন বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। অনেকেই এটাকে নতুন স্বাধীনতা বলেছেন। কিন্তু আমি বলবো, স্বাধীনতা একটাই। সেটাকে আমরা গড়তে পারিনি। কিন্তু ভয়ের যে আবহটা কেটেছে এটা বলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা সংলাপ করছি। সরকারের দায়িত্ব সবার কথা শোনা। দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য তার সংগঠন (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) দেখা করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে। বললেন শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা। তিনি খুব দ্রুত শুনলেন। এরপর দেখলাম সরকার সবার কথা শোনে না। শোনার সময়ও তাদের আছে বলে মনে হয় না। তারা শোনে শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথা। তাদের কথাও যে সরকার শোনে বলে আমার মনে হয় না। তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি হচ্ছে এখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই যে লাখ লাখ কমিউনিটি আছে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন কিনা এনিয়েও প্রশ্ন আছে।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই’র সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, অনেক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলো কিন্তু এখন কথা বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ মানুষ আসে কর্মক্ষেত্রে। তার মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি চাকরি করে। বাকি ২০ লাখ ছেলে-মেয়ের জোগান হয় বেসরকারি চাকরির মাধ্যমে। তাদের চাকরি সম্ভব হবে শুধুমাত্র বিনিয়োগ সঠিকভাবে হলে। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন সামাজিক মূলধন।
তিনি বলেন, সঞ্চয় যদি না করি তাহলে বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? মূল্যস্ফীতির কারণে মজুরি বৃদ্ধির হারও কমে যাচ্ছে। যার কারণে সঞ্চয়ও কমে গেছে। আর্থিক মূলধনের আগে দেশের সঞ্চয় বাড়তে পারবে না। আর ব্যবসা করাটাও কঠিন। এই যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। এটা ৩ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে আলাদাভাবে দেখা যাবে না। এটা একে অপরের পরিপূরক।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা বলেন, ট্যাক্সসেশনের জন্য অটোমেশন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানো যায় ততই ভালো হবে। আদিবাসীদের বিষয়ে বলেন, এখানে পজেটিভভাবে ভাবতে হবে। কারণ আদিবাসীদের অবস্থা খারাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ট্রেড লাইসেন্সের কারণে অনেক নারী পিছিয়ে যাচ্ছেন। ছোট একটা উদ্যোগ নিলে অনেক নারী কিন্তু সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র যারা তাদের ট্যাক্স মওকুফ করা যেতে পারে।
এফবিসিসিআই কমিটি চেয়ার আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ৭০ শতাংশ তরুণ মনে করেন দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের উত্তরণ।
বিসিআই’র সাবেক চেয়ারম্যান শাহেদুল ইসলাম হেলাল বলেন, আমাদের একটা সিস্টেম চালু হয়েছে ঘুষ দেয়া। এমন সিস্টেম চালু হয়েছে যে আমরা কোনো কাজে যাবার আগে খোঁজ নেই এই কাজে আগে কে কতো টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ ছাড়া যাতে কাজ হয় এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস এসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক বলেন, তিন মাস হয়েছে। এখনো ক্রিমিনাল পানিশমেন্ট হয় নাই। এতদিন হয়েছে একটা বিচার হয় নাই। এতদিনে একটা হলেও বিচার করা উচিত ছিল। রাষ্ট্রের কাজ কী বাড়িওয়ালা বানানো? ওয়ার্কারদের জন্য তো বাড়ি দেয়া হয় না, প্লট দেয়া হয় না।
সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, সংস্কার শব্দটা এখন বহুল প্রচলিত। সংস্কার কোন জায়গায় প্রয়োজন নাই। সব স্থানেই রয়েছে। এখন আমলারা হয়েছেন রাজনীতিবিদ আর রাজনীতিবিদরা হয়েছেন আমলা।
সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশিস’র চেয়ারম্যান এমএস শেকিল চৌধুরী বলেন, আন্দোলনের শুরু হয়েছে অর্থনীতি দিয়ে। ছাত্ররা চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। তাদের অবমূল্যায়ন করা যাতে না হয়। ইতিমধ্যে অবমূল্যায়ন করা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ডলার সংকটের জন্য দায়ী অসাধারণ মানুষ নয়। অর্থপাচারের কারণে এটা হয়েছে।
ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অ্যাসিস্টান্ট প্রফেসর পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ক্ষতি হচ্ছে। ইন্ডেক্স স্যালারি করুন। যাতে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ও বেড়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের একটা অংশ তাদের বেতনের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। একটা চক্র কম টাকায় দেয়া তেল, চাল, ডাল কিনে ফেলছে। এটা দূর করতে সাধারণ মানুষের এনআইডি কার্ড দিয়ে বিক্রি করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসূফ বলেন, উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু রাস্তায় কিন্তু এর প্রভাব দেখা যায় না। তথ্যও ভুল রয়েছে। আমাদের বলা হচ্ছে মানুষ ১৮ কোটি। অনেকে বলবে ১৯/২০ কোটি। আমাদের তথ্যটা রি-চেক করা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, কে কে ডাল, চাল, তেল আমদানি করে আমরা তো জানি। একটা কী বৈঠক হয়েছে বাণিজ্যিক মন্ত্রণালয়ে? আমরা এখন চাল আমদানি করি না। যদি চাল আমদানি করা লাগে কীভাবে করবে সেটার বৈঠক করেছেন?
ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান সবুর খান বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশের প্রতিটি পরিসংখ্যান চেক করা হোক। অবৈধভাবে ব্যবসা করছে অনেকে তো বৈধভাবেও ব্যবসা করছেন। কতোজন করছেন সেটা জানা দরকার। ঋণখেলাপির কথা বলা হচ্ছে। ট্যাক্স ফাইল দেখা হচ্ছে না। যেকোনো লোন ফাইল নেয়া হোক একটা ট্যাক্স ফাইলে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হোক।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, উন্নয়ন নিয়ে যত কথা হয়, কর্মসংস্থান নিয়ে তত কথা হয় না। ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে না বিধায় আমরা আমাদের জায়গা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।
এফবিসিসিআই সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন প্রয়োজন। আর এনার্জি সেক্টর সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদিক মাহবুব ইসলাম বলেন, দিনশেষে আমার ওয়ালেটটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্রেজটা আছে কারণ প্রাইভেট সেক্টরের গ্রোথটা হয়নি। প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কমে এসেছে। এসব কারণেই কিন্তু আন্দোলনটা শুরু হয় পরবর্তীতে বৃহৎ আকার ধারণ করে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থী সুপ্রভা শুভা জামান বলেন, আমাদের প্রজন্মের যারা আছি তারা একই সরকার দেখে এসেছি। আমাদের কমন ন্যারেটিভ উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা কিন্তু ভালো উদ্যোগ দেখি নাই।
সভাপতির বক্তব্যে সিজিএস’র চেয়ার মুনিরা খান বলেন, দেশের বাইরে অর্থপাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মিডিয়ার ভূমিকা আছে দেশের অর্থনীতির দুর্বলতা নিয়ে কথা বলার। মিডিয়া যখন দেশের ব্যাংকগুলোকে দুর্বল বলে তালিকাবদ্ধ করে তখন সেখান থেকে টাকা সরিয়ে ফেলার প্রবণতা উল্টো বেড়ে যায়, টাকা পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। এতে ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। আমরা যৌক্তিক সমালোচনা করবো, দেশের অর্থনীতি অথবা সরকারকে বিপদে ফেলে নয়।
No comments