এসডো’র গবেষণা: শিশুদের খেলনায় বিষাক্ত সিসা, ঝুঁকিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

সামপ্রতিক এক গবেষণায় বাংলাদেশে শিশুদের ব্যবহৃত খেলনা ও অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্যে উচ্চ মাত্রায় সিসা শনাক্ত হয়েছে। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো এর রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করা হয়। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ২৫০টি পণ্যের মধ্যে ১৫৭টি পণ্যেই সিসা শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে ৫৯% পণ্যে ৯০ পিপিএমের অধিক মাত্রার সিসা রয়েছে, যাতে ১৩৭০ পিপিএম মাত্রা পর্যন্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। ‘দ্য সাইলেন্ট পয়জন: ট্রেসেস অফ লেড ইন চাইল্ডহুড ট্রেজার্স’ শীর্ষক এই গবেষণা এসডো’র ২০১৩ সালের গবেষণার ধারাবাহিকতা। যা শিশুদের খেলনায় সিসা, ক্যাডমিয়াম এবং থ্যালেটসের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রকাশ এবং এর মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে ফিলিপাইনের ‘ব্যান টক্সিক্স’ নামক বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বে আবারো বাংলাদেশে শিশুদের খেলনা পরীক্ষা করা হয়। পুনরায় ২০২৪ সালে ‘ব্যান টক্সিক্স’-এর গবেষকগণ বাংলাদেশে এসে স্থানীয় বাজার থেকে সরাসরি শিশুদের পণ্য সংগ্রহ করেন এবং এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স (ঢজঋ) মেশিন ব্যবহার করে সেগুলোতে সিসার মাত্রা বিশ্লেষণ করেন।

গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলসমূহ: শিশুদের খেলনায় উচ্চ মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে, যা ১.৬৮ পিপিএম থেকে ৩৭৯ পিপিএম পর্যন্ত বিস্তৃত। পরীক্ষিত ২৫০টি পণ্যের মধ্যে ১৫৭টি পণ্যেই সিসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৯২টি পণ্যে সিসার পরিমাণ নিরাপদসীমা ৯০ পিপিএমের চেয়ে বেশি। একটি শিশুদের পানির মগে ১৩৮০ পিপিএম সিসা, ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক এবং ১৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে-প্রতিদিনের ব্যবহৃত একটি সাধারণ পণ্যে এই বিপজ্জনক রাসায়নিকের উপস্থিতি উদ্বেগজনক। শিশুদের ব্যবহৃত স্টেশনারি ব্যাগে ৫৮০ পিপিএম সিসা, ১২৮০ পিপিএম বেরিয়াম এবং ৮৮ পিপিএম পারদ পাওয়া গেছে-যা পড়াশোনার সরঞ্জামকেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত করেছে। একটি পুতুল সেটে ১৬০ পিপিএম সিসা এবং ১৫০০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে-যা শিশুর প্রিয় খেলনাকেও বিপজ্জনক করেছে। শিশুদের ব্যবহৃত একটি মগে ২২০ পিপিএম সিসা, ৩১৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম এবং ১৬৮০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে- যা দৈনন্দিন ব্যবহারে শিশুকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। একটি নামকরা শপিংমল থেকে সংগ্রহ করা একটি পুতুল সেটেও ৫০০ পিপিএম সিসা পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে উচ্চমানের পণ্যও সিসা থেকে মুক্ত নয়।

একটি বর্ণমালা সেটের একটি উজ্জ্বল বর্ণমালার অক্ষরে ৬৬০ পিপিএম সিসা পাওয়া গেছে-যা শিক্ষার পণ্যকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিভিন্ন দেশ- যেমন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং অস্ট্রেলিয়ায় সিসার মাত্রার জন্য সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে এখনো এমন কোনো আইন বা নিয়ম নেই। এসডো’র চেয়ারপারসন এবং  সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, শিশুদের পণ্যে সিসার উপস্থিতি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষার জন্য আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এসডো’র মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন খেলনার সুরক্ষা নিয়ে বলেন, খেলনা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক, কিন্তু যখন তাতে সিসার মতো বিষাক্ত পদার্থ থাকে, তখন তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এই খেলনাগুলো শিশুদের স্বাস্থ্য এবং বিকাশের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে খেলনাগুলো সিসামুক্ত হওয়া জরুরি। এসডো’র নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর সিসার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রক্তে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই- যেকোনো পরিমাণে সিসা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ। কারণ তাদের শরীর দ্রুত সিসা শোষণ করে, যা মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি একটি স্বাস্থ্য সংকট, যার জন্য এখনই আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন। এসডো ইতিমধ্যে বিএসটিআই’র সঙ্গে এই বিষয়ে নীতিমালা তৈরিতে কাজ করছে। অনুষ্ঠানে মূল উপস্থাপনা করেন এসডো’র প্রোগ্রাম এসোসিয়েট শ্যানন ইফাত আলম।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.