মানিকগঞ্জের ছায়ামন্ত্রী আফসার শতকোটি টাকার মালিক by রিপন আনসারী

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দুর্নীতির আগ্রাসনের প্রধান খলিফা আফসার উদ্দিন সরকার। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি তার নিজ ইউনিয়নের বিতর্কিত চেয়ারম্যান। মন্ত্রীর সমস্ত অবৈধ  কাজের রাজসাক্ষীও তিনি। এ ছাড়া অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সব ধরনের তদবির বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, থানা নিয়ন্ত্রণ, বালুমহাল, ঠিকাদারি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকসহ এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে তার সম্পৃক্ততার হাত পড়েনি। নামে-বেনামে ফসলি জমি থেকে শুরু করে অঢেল জায়গা-সম্পত্তি রয়েছে তার। দেশ-বিদেশে রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা। জাহিদ মালেকের অনিয়ম আর দুর্নীতির অঘোষিত ছায়ামন্ত্রী হিসেবেই নিজেকে আবিষ্কার করেছেন আফসার। মানবজমিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার অজানা অনেক তথ্য। জাহিদ মালেকের পিতা এরশাদ সরকারের শাসনামলে ঢাকা সিটির প্রয়াত মেয়র কর্নেল আব্দুল মালেকের অনুসারী ছিলেন আফসার। পরিবারের প্যাঁচগোছের আত্মীয়তার সুবাদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক মামা-ভাগ্নের। সেই সুবাধে তিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরপরই আফসার সপরিবারে পালিয়েছেন।

সরজমিন গড়পাড়া ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ হাটে প্রবেশ করার মুখেই চোখে পড়ে আফসার সরকারের পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়িটি। আলিশান এই ভবনটি বেশির ভাগ কক্ষই ভাড়া দিয়েছেন। এরপর বাংলাদেশ হাট থেকে কিছু দূরে গ্রামের বাড়ি ডাউলি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় তৃতীয় তলাবিশিষ্ট আরেকটি বাড়ি। বাড়িটি কয়েক বিঘা জায়গার উপর। বাড়ির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। তাছাড়া গ্রামের বাড়ির চারপাশে তার রয়েছে অঢেল সম্পদ। শুধু গ্রামের বাড়িতেই সম্পদের পাহাড় নয়; গড়পাড়া ইউনিয়নের আরও বেশ কিছু এলাকায় রয়েছে তার শত শত বিঘা সম্পত্তি। তিনি কতো বিঘা সম্পত্তির মালিক সেটা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি। জেলা শহরের কালীবাড়ি এলাকায় বহুতল ভবনে রয়েছে কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট। সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের আশপাশে এবং সদর  উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে তার কোটি টাকা মূল্যের নিজস্ব জায়গা।
অভিযোগ রয়েছে গড়পাড়া এলাকায় বাংলাদেশ হাট সংলগ্ন তার পাঁচতলা ভবনের জায়গা নিয়ে। কয়েক বছর আগে এলাকার ৯০ বছরের বৃদ্ধ অসহায় সাহাম উদ্দিনের স্ত্রী আছিয়া খাতুনের নামে ৭ শতাংশ জায়গার মধ্যে সোয়া ৪ শতাংশ তিনি লিখে নেন। বাজারদর অনুযায়ী প্রতি শতাংশ ১০ লাখ টাকার উপরে বিক্রি করার স্বপ্ন ছিল ওই বৃদ্ধের। কিন্তু ভয়ভীতি ও প্রভাব বিস্তার করে লামছাম টাকা দিয়ে জায়গাটি লিখে নেয়া হয়। বৃদ্ধ সাহাম উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ওই সময় অনেকেই বেশি দামে আমার জায়গা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান আমাকে বিক্রি করতে দেয়নি। যারা কিনতে এসেছিল তাদেরও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।
এলাকার নুরে আলম বলেন, বাংলাদেশ হাটে আমাদের বাপ- চাচার নামে লিজ নেয়া ১১০ শতাংশ জায়গার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গা আফসার চেয়ারম্যানের লোকজন জবর দখল করে দোকানপাট তুলেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের নিজস্ব একটি জায়গায় অন্যকে দিয়ে মামলা করিয়ে জায়গাটি স্টে অর্ডার করে রাখা হয়েছে। এসব করেছে জাহিদ মালেকের শেল্টারে। মূলত মন্ত্রীর কাঁধে ভর করে চেয়ারম্যান আফসার অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এলাকার হিন্দু সমপ্রদায়ের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, শুধু মানিকগঞ্জেই নয় আফসার সরকারের ভারতেও বাড়ি রয়েছে। সেটা এলাকার অনেকে জানে।
এলাকাবাসী জানান, এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে মাদকের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়পাড়া ইউনিয়নকে কলঙ্কিত করেছেন আফসার সরকারের মেয়ের জামাই মহব্বত হোসেন। মাদক বেচাকেনার ভাগও পেতেন আফসার। প্রধান শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও শ্বশুরের বদৌলতে তাকে জাহিদ মালেকের নামে গড়পাড়া জাহিদ মালেক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একজন শিক্ষক হয়েও তার এই অপকর্ম এলাকার মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পায়নি। মাসের বেশিদিনই অনুপস্থিত থেকেছেন। শুধুমাত্র মাস শেষে সাইন করে বেতনের টাকা উত্তোলন করেন। শুধু মাদকই নয় এলাকার বিচার- সালিশ, বাণিজ্যসহ নানান অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন মহব্বত। আফসার সরকারের একমাত্র ছেলে ঝিনুক সরকার গড়পাড়া এলাকায় নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাছাড়া ব্যাংক এশিয়ার এজেন্টও ছেলের নামে আনা হয়েছে। পিতার অপকর্মের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে না পারে তার জন্য এলাকায় তৈরি করেছিলেন নিজস্ব বাহিনী।  
আফসার সরকারের অর্থ বাণিজ্যের আরেকটি খাত ছিল নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার ব্যবসা। এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মেহেদি হাসান সম্রাট নামের এক  আত্মীয়। সম্রাট ১২ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করলেও এলাকায় তার ডুপ্লেক্স বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার রয়েছে নিজস্ব গাড়ি। আফসার সরকারের জমি সম্পর্কিত বিষয়াদি দেখতেন গড়পাড়া এলাকার দু’জন ব্যক্তি। তাছাড়া মানিকগঞ্জের জয়রা এলাকায় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিতার নামে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জায়গা কেনাবেচা এবং মাটি ভরাটের দায়িত্বে ছিলেন আফসার সরকার। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন। তাছাড়া কর্নেল মেডিকেল কলেজ হসপিটালে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জামাদিসহ সব কিছুই কেনাবেচা আফসার সরকারের মাধ্যমে করতো কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে খণ্ডকালীন যে সমস্ত শ্রমিককে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে ৩-৪ লাখ টাকা করে উৎকোচ নিয়েছে।
জাহিদ মালেক দুই মেয়াদে মন্ত্রিত্ব থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন তদবির, চাকরি, বদলিসহ ওই মন্ত্রণালয়ের এমন কোনো বাণিজ্য ছিল না যা আফসার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো না। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে দিয়েই মূলত অবৈধ এসব বাণিজ্য করাতেন। এসব বাণিজ্যে মন্ত্রীর পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিতেন আফসার সরকার। এমনও অভিযোগ রয়েছে  দেশের বড় বড় সরকারি হসপিটালের ঠিকাদারি কাজ পেতে অনেক প্রভাবশালীরা ছুটে আসতো আফসার সরকারের কাছে। তাকে ম্যানেজ করেই মন্ত্রীর কাছ থেকে কাজ বাগিয়ে নেয়া হতো। এতে মন্ত্রী ও আফসার সরকার দু’জনেরই পকেট ভারী হতো।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড টার্মিনালে গণপরিবহন থেকে মাসে প্রায় ১৫ কোটি টাকার চাঁদাবাজির একটা অংশ আফসার সরকারকে দেয়া হতো। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির দায়িত্বে ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান জাহিদ। এ ছাড়া আফসার সরকার মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে মানিকগঞ্জ সদর এবং সাটুরিয়া থানা নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিরোধী পক্ষসহ বিভিন্ন মানুষজনকে যখন খুশি মামলার জালে আটকে দিতেন। তার কথাতেই থানা পুলিশ চলতো। সেখান থেকেও নানাভাবে অর্থ বাণিজ্য করতো আফসার সরকার। মানিকগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার থেকেও আফসার সরকারকে ভাগ দিতে হতো। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতাদেরও কোণঠাসা করে রাখার পেছনে আফসার সরকারের ভূমিকা ছিল। তার অর্থবিত্ত শুধু মানিকগঞ্জকেন্দ্রিকই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পার্শ্ববর্তী ভারত ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে এমন তথ্য মানিকগঞ্জের অনেকেই অবগত রয়েছেন। এদিকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের গড়পাড়ায় বিশাল বাগান বাড়ি এবং ছেলের নামে শুভ্র সেন্টার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন আফসার। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন সেক্টর থেকে আসা টাকার ভাগবাটোয়ারা তিনি নিজে করতেন। বড় একটি অংশ যেত মন্ত্রীর পকেটে। এ ব্যাপারে আফসার উদ্দিন সরকারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এদিকে আফসার সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতার দায়ে ইতিমধ্যে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.