বাবা-মায়ের মাঝে দাঁড়ানো ছোট্ট আহাদ লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে by ফাহিমা আক্তার সুমি

চার বছরের শিশু আব্দুল আহাদ। প্রাণচাঞ্চল্যতায় মাতিয়ে রাখতো ঘর। মা-বাবার দুই সন্তানের মধ্যে আহাদ ছোট। জানুয়ারিতে তাকে স্কুলে ভর্তির কথা ভেবেছিলেন বাবা-মা। তবে সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তাদের। ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন বিকালে বাসার নিচে শিক্ষার্থী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এ সময় ঘুমিয়ে ছিল শিশুটি। ইটপাটকেল ছোড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম চোখে দেখার জন্য দৌড়ে অষ্টমতলার বারান্দায় দাঁড়ায়। তখন বাবাকে বলে, ‘বাবা দেখো নিচে মারামারি হচ্ছে।’ বাবা-মা দু’জনে বারান্দায় আসেন। আহাদ দাঁড়িয়ে ছিল তার বাবা-মায়ের মাঝে। হঠাৎ একটি গুলি এসে আহাদের ডান চোখে বিদ্ধ হলে ঢলে পড়ে মেঝেতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে পরেরদিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাত সাড়ে ৮টার দিকে মারা যায়। রায়েরবাগ মিরাজনগর তিন রাস্তার মোড়ে ভাড়া থাকতো তার পরিবার। আহাদের বাবা আবুল হাসান ঢাকায় কর অঞ্চল-৮ এর উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত। সন্তানকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে শিশুটির পরিবার।

আহাদের বাবা আবুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, নতুন বছরে স্কুলে ভর্তি করার কথা ছিল। আমার ১১ বছরের আরেকটি সন্তান রয়েছে সে মাদ্রাসায় পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ওই বাসাটিতে ভাড়া থাকতাম। আহাদ যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন সকালেও আমার বুকের মধ্যে শুয়ে বলেছিল, ‘বাবা তোমার বুকে খুব ভালো লাগে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্রতিদিন অফিসে নিয়ে যাবা।’ ওর খেলনা গাড়িগুলো খুব পছন্দের ছিল। চিকেন ফ্রাই খেতে খুব ভালোবাসতো। আমাদের স্বপ্ন ছিল ওর বড় ভাই যখন মাদ্রাসায় পড়ে তখন ওকেও মাদ্রাসায় পড়াবো।

ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সেদিন আহাদ ঘুমানো অবস্থায় ছিল। ১১ তলা ভবনের ৮ তলায় ভাড়া থাকতাম। বাসার নিচে সংঘর্ষ চলছিল তখন। সেখানে শিক্ষার্থীরা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম অবস্থায় ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। নিচে যখন চিল্লাচিল্লি হচ্ছিলো সেই শব্দ কানে গিয়ে আহাদের ঘুম ভেঙে যায়। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে বেলকনির দিকে আসে। তখন আহাদ বলে, ‘বাবা দেখো নিচে মারামারি হচ্ছে।’ ওকে বেলকনিতে আসা দেখে আমি আর আমার স্ত্রী দু’জনেই বেলকনিতে আসি। ও আমাদের দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় আচমকা নিচ থেকে হঠাৎ একটা গুলি এসে আহাদের ডান চোখে লাগে। পরবর্তীতে তখনই আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসক দেখে তাকে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে দেন। ২০শে জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার সন্তান মারা যায়। ২১শে জুলাই ময়নাতদন্ত শেষে আমাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে দাফন করা হয়।

আবুল হাসান বলেন, গুলিটা যে নিচ থেকে করেছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে। নিচে কিছু দোকান ছিল সেখানে সিসিটিভি ছিল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে গুলিগুলো ছাত্রলীগ-যুবলীগ করেছে। গুলিটা যখন লাগে তখন আহাদ আর কোনো শব্দ করেনি মেঝেতে ঢলে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে যখন আমরা ধরি তখন আমাদের হাত রক্তে ভিজে যায়। ওইদিনই আরেকজন বয়স্ক লোক নামাজ পড়তে বের হয়ে গুলিতে মারা যান।

তিনি বলেন, আমার বড় সন্তান মেহরাজ হাসান দিহান যখন মাদ্রাসা থেকে কয়েকদিন পরপর বাসায় আসতো তখন আহাদ অনেক খুশি হতো বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল ওদের। ভাইয়ের মাদ্রাসায় গেলে সেখান থেকে আর আসতে চাইতো না। আহাদ ছিল সবার আদরের। বেশি চঞ্চল প্রকৃতির থাকায় সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। সন্তান হারানোর শূন্যতা কাউকে বোঝানো যায় না। ওর আম্মু একদম ভেঙে পড়েছে। সে এখনো ঢাকায় ফেরেনি। আমরা যে সম্পদ হারিয়েছি সেটি কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বড় সন্তান দিহান ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করে থাকে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.