বছরের শুরুতে পাঠ্য বই দেয়া নিয়ে শঙ্কা by পিয়াস সরকার

নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বই প্রস্তুতের জন্য হাতে রয়েছে তিন মাস। কিন্তু এখনো শুরু হয়নি দৃশ্যমান কোনো কাজ। শেষ হয়নি পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কাজ। সিদ্ধান্তের আলোকে পরিমার্জন শেষে কাজ হবে নতুন কারিকুলামের ধরন নিয়ে। আবার বই ছাপানোর প্রাথমিক কাজ বাস্তবায়ন করতে পারছে না দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। গেল কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে পাঠ্য বইয়ের একটি বড় অংশ ছাপা হয়। এবার ভারতে বই ছাপার কাজ দেয়া হচ্ছে না।

এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, আগামী বছরে চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে আসছে পরিবর্তন। বিশেষ করে ইতিহাসনির্ভর তথ্য-উপাত্তে। পরিমার্জন বা বাতিল হতে পারে কিছু অধ্যায়। এর জন্য প্রায় অর্ধশতাধিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করছে সরকার। পুরনো সিলেবাসে বই পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত হওয়ায় বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা ও পৃষ্ঠা। ফলে পুরনো দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। আর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে সামান্য কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসবে। যা পুরনো দরপত্রের মাধ্যমেই ছাপানো হবে। তবে এই তিন শ্রেণির বইও এখনো পরিমার্জনের কাজ শেষ হয়নি।

পুরনো সিলেবাসে পরিমার্জনের মাধ্যমে বই দেয়ার পর কারিকুলাম বাস্তবায়নে হাত দেবে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাপিয়ে দেয়া কারিকুলাম পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা বলছে- এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি পুরনো কারিকুলামেও ফিরে যাচ্ছে না। দুটি কারিকুলাম থেকে সমন্বয় করে হবে নতুন করে সিলেবাস। তবে এক্ষেত্রে ২০১২ সালের কারিকুলামই মোটাদাগে থাকছে।

এদিকে ২০০৯ সাল থেকে ভারতে বই ছাপানো হতো। সম্প্রতি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি ওই টেন্ডার বাতিল ও নতুন করে টেন্ডার করার সিদ্ধান্ত দেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের (১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির) ২০টি প্যাকেজে ৯৮টি লটে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে ২৫২টি দরপত্র জমা পড়ে। এরমধ্যে ২০৯টি দরপত্র রেসপনসিভ হয়। ৯৮টি লটের বিপরীতে ৮৮টি লটে সুপারিশ করা রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪৬টি বই সরবরাহ করার সুপারিশ করা হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১৪৭ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৭ টাকা। প্রতিটি বই মুদ্রণ, কাগজসহ বাঁধাই ও সরবরাহ বাবদ খরচ ধরা হয় ৩৬ টাকা ৭৬ পয়সা। এই ৮৮টি লটের মধ্যে ৭০টি লটের সর্বনিম্ন দরদাতা ৭০টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং অবশিষ্ট ১৮টি লটের মধ্যে ২টি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা। বাকি ১০টি লটের জন্য রেসপনসিভ দরদাতা নেই। এ কারণে এই ১০টি লটের পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে দুটি লটের বই নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে দুটি লটেও নতুন করে দরপত্র নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ভারতে গত বছর বই ছাপিয়েছিল প্রিতম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড ও পাইওনিয়ার প্রিন্টার্স। এই প্রিন্টার্সকে কাজ দিতে লিয়াজোঁ করেছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার বলয়ের লোকজন। লিয়াজোঁ রক্ষা করতেন দীপু মনির ভাই ওয়াদুদ টিপু ও চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। এজন্য উৎকোচ নেয়ারও অভিযোগ আছে।

ছাপানোর দায়িত্বে এনসিটিবি থাকলেও ডা. দীপু মনি নিজে পড়ে দেখার জন্য নিতেন পাণ্ডুলিপি এবং দীর্ঘদিন নিজের কাছে আটকে রাখতেন। এর জন্য বরাবরই বই ছাপাতে দেরি হতো। প্রতি বছর প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হতো। অজানা এক কারণে একই চক্র পেতো বই ছাপানোর কাজ। কাজগুলো বাগিয়ে নিতো সেগুলো একই মালিকের প্রতিষ্ঠান। দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে অস্বাভাবিক কাজ দেয়া, নির্ধারিত সময়ে বই না দেয়ার পরও জরিমানা হতো না। সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ দেয়া হতো অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস এবং কচুয়া প্রেসকে। যারা ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বই ছাপানোর কাজ বাগিয়ে নেয়। এমনকি এই দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বই সরবরাহ করে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ থেকে ৫ মাস দেরিতে বই দেয়ার পরও এনসিটিবি সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের বই ডিসেম্বরে ডেলিভারি দেখানো হয়েছে। পুরো জালিয়াতির সঙ্গে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান-উৎপাদন নিয়ন্ত্রক জড়িত ছিল। এমনকি সেই সময়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অভিযোগ জানালেও নেয়া হয়নি ব্যবস্থা। আবার বিনামূল্যে বই ছাপার কাগজ কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে এনসিটিবির একটি চক্র। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত কাগজ বাজারদরের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কেনা হয়েছে। বাড়তি দামে কেনা হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ আর্টকার্ডও। ফলে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। নতুন বছরের প্রাথমিকের বইয়ের সিদ্ধান্ত হলেও এখনো মাধ্যমিকের সিদ্ধান্ত আসেনি। যার কারণে যথাসময়ে বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা লেখক রাখাল রাহা বলেন, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন কাজে যুক্ত আছি। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক দল করা হয়েছে। একইসঙ্গে কারেকশনগুলো কম্পিউটারে আপডেট করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী ৩০ তারিখের মধ্যে প্রাথমিক কাজ শেষ হবে। এরপর প্রস্তুত হলে সেটি শুধু রিচেক করার কাজ বাকি থাকবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি’র সদ্য দায়িত্ব পাওয়া চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ২০১২ সালের কারিকুলামের আলোকে বই পরিমার্জন ও টেন্ডার প্রক্রিয়া এ মাসেই সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। ২০১২ সালের কারিকুলামের আলোকে যে বইগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলো মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে পরিমার্জনের কাজ চলছে। সবমিলিয়ে অনেক বই, সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আশাকরি এ মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে। এরইমধ্যে টেন্ডার হয়ে যাবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এ মাসের মধ্যে শেষ করা। সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গত বুধবার আগামী ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখেই পাঠ্যপুস্তক প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা পাবে বলে জানিয়েছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ক্রয় কমিটির সভার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর ব্যাপারে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যথা সময় যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বই পায় সেটা নিশ্চিত করা হবে। বইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বইয়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.