চীনকে মোকাবিলায় ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে সামুদ্রিক টহল জোরদারের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করতে যৌথ উদ্যোগে সমুদ্রে নৌ-শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের সঙ্গে এই জোটে  থাকছে অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং জাপান। এ ছাড়া এই অঞ্চলের সমুদ্রে নিজেদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পরিকল্পনাও করেছে চীন-বিরোধী এই জোট। যৌথ এই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা। জাপানের কিয়োডো নিউজকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস। ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের  নেতৃত্বে ২১শে সেপ্টেম্বর আসন্ন কোয়াড সম্মেলনের সময় এই পরিকল্পনার রূপরেখা প্রকাশ করা হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা উভয়ের জন্যই তাদের প্রত্যাশিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এটি সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হতে পারে। তাদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। কোয়াড আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্মুখী নিরাপত্তা সংলাপ নামে পরিচিত। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের যে কৌশল রয়েছে তার বিপরীত হিসেবে দেখা হচ্ছে এই পরিকল্পনা। বাইডেন প্রশাসন সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাকে আরও গভীর করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে কোয়াডকে উন্নত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে যৌথ সামুদ্রিক টহল বৃদ্ধির মাধ্যমে চীনকে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করছে এসব দেশ। যৌথ এই উদ্যোগ আগামী বছর থেকে শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্রটি। এর মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমুদ্রে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের যৌথ টহল বৃদ্ধি পাবে। অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক জোরালো করার লক্ষ্যে এবং এই মিশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে সমুদ্রে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চায় সদস্য দেশগুলো। কোয়াড সম্মেলনের মাধ্যমে সামুদ্রিক সহযোগিতা উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যান্য  ক্ষেত্রেও নিজেদের সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে চায় এসব দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরে ওপেন রেডিও অ্যাক্সেস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী যোগাযোগ গড়ে তোলাও এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপভুক্ত দেশগুলোতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের বিষয়ে কোয়াড সদস্যদের উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে। তারা প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এসব অঞ্চলে চীনা প্রভাব বৃদ্ধির ঝুঁকি কমাতে চায়। এ ছাড়া কোয়াড বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পরিকল্পনাও করেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর পরবর্তী বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এসব দেশ ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়ে এগোচ্ছে। এর পাশাপাশি এসব দেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের জন্য সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কোয়াডের যৌথ টহল কীভাবে আঞ্চলিক গতিশীলতাকে নাড়া দেবে?
দক্ষিণ চীন সাগরে আঞ্চলিক বিরোধকে কেন্দ্র করে ম্যানিলা এবং বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এই জোট নিজেদের শক্তিশালী করতে চাচ্ছে। চীনা কোস্টগার্ড এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছে যা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। গত বছরের অক্টোবরে চীনের সামরিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চীন ২০২১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫০টির বেশি টহল জাহাজ নামিয়েছে। চীনের জাহাজগুলো উচ্চশক্তি সম্পন্ন হেলিকপ্টার, জল কামান এবং একাধিক ইন্টারসেপ্টর বোট দিয়ে সজ্জিত। ১০ই সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরে (ডব্লিউপিএস) চীনের টহলকৃত জাহাজের সংখ্যা পৌঁছেছে ২০৭ টিতে, যা এই বছর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এসকোডা (সাবিনা) শোলের আশেপাশে এই বৃদ্ধি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা দক্ষিণ চীন সাগরে ম্যানিলা এবং বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান সামুদ্রিক বিরোধের একটি নতুন ফ্ল্যাশপয়েন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

৯ই সেপ্টেম্বর মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল পাপারো, দক্ষিণ চীন সাগরে কমান্ডার জেনারেল উ ইয়ানানের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। পাপারো বলেছেন, এই ধরনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল গণনার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। পাপারো চীন এবং মার্কিন মিত্রদের মধ্যে সামপ্রতিক ‘অনিরাপদ  যোগাযোগের’ কথা উল্লেখ করেছেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম মেনে চলার জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ চীন সাগর এবং অন্যত্র বিপজ্জনক, জবরদস্তিমূলক এবং সম্ভাব্য বৃদ্ধিমূলক কৌশল ব্যবহার করার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার জন্য চীনকে আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে, ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক শশাঙ্ক এস প্যাটেল ইউরোএশিয়ান টাইমসকে বলেছেন, ২০২২ সালের টোকিও শীর্ষ সম্মেলনের পরই এই যৌথ টহল উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেখানে নেতারা ইন্দো-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ফর মেরিটাইম ডোমেন অ্যাওয়ারনেস (আইপিএমডিএ) চালু করেছিলেন। আইপিএমডিএ উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি, তথ্য আদান-প্রদান এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে আঞ্চলিক সামুদ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে সব দেশই পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একমত হয়েছে। প্যাটেল উল্লেখ করেছেন, গত দুই বছর ধরে যৌথ টহল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা অনেকটাই মৃত ছিল, সমুদ্রে আঞ্চলিক প্রভাব পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অপেক্ষায় ছিল। তবে জাপান, ফিলিপাইন এবং তাইওয়ানের জলসীমায় চীনা আগ্রাসন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই জোট সক্রিয় হওয়ায় অক্সিজেন পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্যাটেল। তিনি বলেছেন, ফিলিপাইনের স্কারবোরো অ্যাটলের উপর চীনের তথাকথিত দশম শতাব্দীর পূর্বপুরুষের আঞ্চলিক দাবি কোয়াডকে তাদের যৌথ টহল কর্ম পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে প্ররোচিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর যৌথ টহলের মাধ্যমে আঞ্চলিক গতিশীলতায় চীনের ওপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্যাটেল বলেছেন, চীন প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সার্বিক দিকে তার উপস্থিতি এবং নির্মাণ কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। কোয়াডের যৌথ টহল পরিকল্পনা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে (আইপিআর) চীনা রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদী স্বার্থকে প্রতিহত করতে পারে বলে ধারণা প্যাটেলের। এর জন্য কিছু উপায়ে কাজ করা যেতে পারে। চীনা নৌযানগুলোকে আঞ্চলিক জলসীমার বাইরে রাখা গেলে মূল রুটে যৌথ অবরোধের মাধ্যমে এই অঞ্চলের দ্বীপ দেশগুলোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস দিতে পারে বলে মনে করেন ওই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কিন্তু এটি আবার চীনা বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। কেননা, কোয়াড তাদের জোটের মাধ্যমে একটি ‘এশীয় ন্যাটো’ গঠন করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে চীনও তার শক্তি বৃদ্ধির পথে আরও অগ্রসর হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.