কসবাতেও ছিলেন একজন বিদ্যুৎমন্ত্রী by জাবেদ রহিম বিজন

নিজেকে বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিতেন কসবার পানিয়ারুপ গ্রামের মো. বাবুল মিয়া। দেশের মন্ত্রী আনিসুল হকও গ্রামের বাড়িতে এলে বিদ্যুৎমন্ত্রী কই বলেই শুধাতেন তাকে। আর পায় কে বাবুলকে। এখন অবশ্য আত্মগোপনে এই মন্ত্রী। উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক  হওয়ার সুবাদে বাবুল তার রাজত্বে পরিণত করেন ওই বিদ্যুৎ সমিতিকে। তিনি যা বলেছেন বিদ্যুৎ অফিসে তাই করেছেন। তাকে ম্যানেজ না করে কেউ কোনো কাজ করতে পারেনি। টাকা  দিলেই হয়েছে কাজ। তা না হলে বসেনি খুঁটি, মিলেনি সংযোগ-মিটার কোনোকিছুই। বিদ্যুতের ঠিকাদারি কাজও ছিল তার কব্জায়। খুবলে খেয়েছেন বাবুল কসবার বিদ্যুৎ সেক্টরকে। চাহিদামতো টাকা না পাওয়ায় নিজের গ্রামের একটি মসজিদের খুঁটি পরিবর্তনের কাজ ফেলে রাখেন ১১ বছর। যা সরকার পরিবর্তনের পর এক সপ্তাহেই হয়েছে।

পানিয়ারুপ গ্রামের কাজী আমিন বলেন, তিনি ছিলেন বিদ্যুতের পরিচালক। সেখানে যত কাজ ছিল তার মাধ্যমেই করতে হতো। টাকা না দিলে কাজ হয়নি। তাকে টাকা না দেয়ার কারণে গ্রামের একটি মসজিদের খুঁটি ১১বছর পরিবর্তন হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর যা এক সপ্তাহে হয়েছে। নোয়াগাঁও পশ্চিমপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের তার টানা ছিল। সেজন্য মসজিদ দোতলা করা যাচ্ছিল না। আমরা আবেদন করে বাবুলের মাধ্যমে সেটি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। বাবুল মসজিদ কমিটিকে বলেন- খুঁটি একটি নয়, ৩টি পরিবর্তন করতে হবে। এজন্যে আরও টাকা লাগবে। দেড়লাখ টাকা দাবি করেন। এখন ৪০ হাজার টাকা দিয়ে এক খুঁটি সরিয়েছি, সময়ও লেগেছে এক সপ্তাহ। একই গ্রামের মো. জুলহাস বলেন- গ্রামের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছিল তাকে নিয়ে। সেখানে শুনেছি এক লোকের কাছ থেকে মিটার দেবে বলে ২ লাখ টাকা নিয়েছে।

নামপ্রকাশ না করার অনুরোধে কসবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক এক পরিচালক বলেন-পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ঠিকাদারিতে জড়িত বা কোনো সময় এখানে চাকরি করতেন এমন কেউ ডাইরেক্টর হতে পারবে না বলেই নিয়ম। কিন্তু বাবুল সে নিয়ম ভেঙেই পরিচালক হয়েছেন। মন্ত্রীর  দোহায় দিয়ে আইন মানেনি। নির্বাচন ছাড়া বিনা ভোটে পরিচালক হন একাধিকবার। আগে এখানে খুঁটির ব্যবসা, দালালি করতো সে। এরপর কর্মকর্তাদের বদলির ভয় দেখিয়ে ফায়দা নিয়েছে। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আমি যখন ডাইরেক্টর তখন সে একদিন অফিসে বলেছে, ‘উনিতো ডাইরেক্টর, আমি উপমন্ত্রী’। এরপর আমি আর  সেখানে থাকিনি। সাবেক এক নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে বাবুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলেও জানান ওই পরিচালক। তার বদলি ঠেকিয়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা করে ফায়দা নিয়েছেন তিনি।

কসবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ-মহাব্যবস্থাপক  মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বাবুল গত ৪ বছর ধরে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন কাজে তার সুপারিশ থাকতো। আবাসিকের, শিল্প সংযোগের সুপারিশ করেছেন। কত কাজেই তো সুপারিশ করেছেন। এখানে কি কাজ হয়েছে বা কারা এই কাজ করেছেন, সেটি আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেড অফিস থেকেই বলতে পারবে। এখান থেকে কোনো টেন্ডার হয় না, ওয়ার্ক অর্ডারও হয় না। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন হয়েছে এই উপজেলায়। সংযোগ হয়েছে ৮২৯৭ টি।

তবে এই ক’বছরে ওই উপজেলায় কি কাজ হয়েছে সে তথ্য পেতে গিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. মকবুল হোসেন জানান, নির্মাণের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ লাইন নির্মাণ, অফিস ও সাবস্টেশন ভবন নির্মাণসহ সব সিভিল কাজ হয় সিলেট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে। সিলেট জোনে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ১২টি সমিতি রয়েছে। সিলেটে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ নিয়াজ মুহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, একবছর হয় তিনি এখানে এসেছেন। আগে সেখানে কি কাজ হয়েছে তার জানা নেই। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কাজের তথ্য তার কাছে নেই, জিএম অফিসে আছে বলে জানান। আবারো মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তার কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপকের (টেকনিক্যাল) সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য নিতে বলেন।  রোববার ঘাটুরায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অফিসে গিয়ে ডিজিএম টেকনিক্যাল আবু সায়ীমকে পাওয়া যায়নি। ফোন করলে তিনি আশুগঞ্জে রয়েছেন এবং তাকে এ ধরনের তথ্য দিতে বলা হয়নি বলেও জানান। গতকাল মঙ্গলবার আবারো তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তথ্য দেয়ার ব্যাপারে তাকে কিছু বলা হয়নি বলেই জানান। পরে আবার ফোন করে জানান, এক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারকে তথ্য দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে মহাব্যবস্থাপক জানান-২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ হয়েছিল। তখন অনেক টাকার কাজ হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী, বর্তমানে ঢাকায় পরিচালক হিসেবে কর্মরত আলতাফ হোসেন বলেন, বাবুল মাঝে-মধ্যে সমিতির অফিসে আসতো সেই হিসেবে চিনতাম। সে গ্রামের একটা লোক তাকে দিয়ে আমার কী কাজ হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে চিনতেন না বলেও জানান তিনি।  সম্প্রতি কসবা শহরের স্টেশন থেকে টি আলীর বাড়ির মোড় পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণ করে ডিভাইডারের কাজ হয়। এ জন্যে বিদ্যুতের খুঁটি সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে নিতে এক-দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু এই তথ্যও মিলেনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।  বিদ্যুতের কাজের পাশাপাশি উপজেলায় বেশকয়েকটি সরকারি অফিস ভবন নির্মাণ কাজের ঠিকাদারিও করেছেন বাবুল। সরকার পতনের পরই পালিয়েছেন এলাকা ছেড়ে। পানিয়ারুপে তার বড়সড় একটি পাকা বাড়ি, অনেক সহায়-সম্পদ ছাড়াও ঢাকার টঙ্গীতে জায়গা রয়েছে। তার ২ সন্তান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.