শিক্ষা তথ্যই শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ভ্যানগার্ড by হাবিবুর রহমান

অশ্রুসিক্ত একজন শিক্ষক চোখের পানি মুছতে মুছতে প্রবেশ করলেন আমার অফিস কক্ষে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় উদ্বিগ্ন এ শিক্ষক দেড়যুগ বিনা বেতনে পাঠদান করে আসছেন। পাঁচ কন্যার জনক এ শিক্ষক দেড়যুগ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করে আজ যখন প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হলো তখন তাকে বাদ দিয়ে প্রধান শিক্ষক সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী নেতার স্ত্রীকে ২০১৮ সালে বসে ২০০১ সালে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে রাতারাতি তাকে গৃহিণী থেকে  ২০ বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষক বানিয়েছেন। বিনিময়ে সরকারি দলের নেতাকে গুনতে হয়েছে মোটা অংকের টাকা। তবু ভালো মানুষ গড়ার কারিগর মহান পেশা শিক্ষকতায় পরিচয় হলো নেতার স্ত্রীর এটা কম কিসের। কিন্তু কপাল পোড়ালো কালাম সাহেবের। তিনি বিনা বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করে শিক্ষকতা করেছেন দেড়যুগ আর এমপিওভুক্ত হওয়ার পর কালাম সাহেবের চাকরি নেই! কালাম সাহেব অঝোর ধারা অশ্রুসিক্ত হয়ে সব কষ্টের কথাগুলো আমাকে বলে কিছুটা হালকা হওয়ার সুযোগ নিলেন। নিথর ও নির্বাক হয়ে কালাম সাহেবের সব কথা শুনলাম। নেত্রকোনা জেলার নতুন এমপিওভুক্ত আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালাম সাহেবের মতো চাকরি হারানো অসহায় শিক্ষকের কথা শুনালো কালাম সাহেব আমাকে। অতিরিক্ত টাকার চাপ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে নয়তো রাজনৈতিক ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। এতদিন যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ত্রিসীমায় আসতো না আজ তারাই সর্বেসর্বা। কালাম সাহেবের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল নেত্রকোনা জেলার ভুক্তভোগী কিছু শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে।

বিষয়টি আমার ডেস্কের কাজ না হলেও আমি কালাম সাহেবের মতো বৈষ্যমের শিকার  অসহায় বঞ্চিত ও নিপীড়িত শিক্ষককে শিক্ষার বৃহত্তর এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সহযোগিতা করার জন্য   মনস্থির করলাম। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে এমপিওভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কালাম সাহেবের এ গল্প মূলত ২০১৮ সালের ১২ই জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ)  জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করার পর থেকে সারা দেশের সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনবল কাঠামোতেই আবির্ভাব ঘটে। একই ধারা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও চলে। ২০১৮ সালের নীতিমালার আলোকে ২০১৯ সালে মোট ২৬৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ করা হয়। দীর্ঘদিন এমপিওভুক্ত বন্ধ থাকা এবং অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিএনপি সরকারের  শাসন আমলে স্থাপিত হওয়ায় জনবল কাঠামোও ওই ঘরানার বলেই কালামদের গল্প ট্রাজেডি ।  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সমস্যা শিক্ষার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষার গুণগত মান অনিশ্চিত হবে। এমপিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্যারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। সমাধানের পথও বলে দিলাম। তিনি মনে নিলেন কিন্তু মেনে নিলেন না। কোনো উদ্যোগ নেয়া হলো না। এটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমার মতো ছোট মানুষের চিন্তা জাতীয় কোনো বিষয়ে একেবারেই অমূলক অবান্তর। থমকে দাঁড়ালাম কাউকে বুঝাতে না পেরে। কিন্তু কালামকে মডেল ধরে এগোতে চাই। সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। কালাম ওই স্কুলের বৈধ শিক্ষক। ২০০১ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। হাজারটা প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একটা মিথ্যার কাছে সত্য হেরে যাবে তা হতে পারে না। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
যুদ্ধ শুরু হলো একদিকে প্রধান শিক্ষক ও সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতার টাকা আরেক দিকে অসহায় শিক্ষক কালাম।
২০২১ সালে সরকার আবার এমপিওভুক্তকরণের উদ্যোগ নেয়। নীতিমালার আলোকে ২৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ করে ২০২২ সালে। কালামের গল্প এবার আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করলো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষকরা প্রতিদিন আমাদের কাছে আসেন। সমাধান চান। করণীয় জানতে চান। মাননীয় সংসদ সদস্যরা সরাসরি জড়িত এ নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে বলে তারা অভিযোগ করেন। মোটা অংকের লেনদেন হয় বলে জানায় ভুক্তভোগী শিক্ষকগণ।

অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা কৌশল বের করলাম। যেহেতু সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। সুতরাং সরাসরি  তাদের দায়ী না করে কৌশলে সরকারের স্বার্থকে সামনে এনে বড় করে দেখাতে হবে যা শিক্ষা প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ছোট মানুষ তাও আমার ভাবনাটাও ছোট। আমি তাদেরকে মহাপরিচালক, ব্যানবেইস বরাবর অভিযোগ দিয়ে আবেদন করার পরামর্শ দিলাম। কালামসহ ১০টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে দেখলাম তারা সবাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বৈধ শিক্ষক। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে তথ্যটি যাচাই-বাছাই করে পেলাম তা হচ্ছে ২০১৩ সালে   কালাম সাহেবের স্কুলে বৈধ ৫ জন শিক্ষকসহ স্টাফ  ছিল ৭ জন।  কিন্তু এমপিওভুক্তকরণের পর ২০২০ সালে হয়ে গেল ১৩ জন। অথচ ২০০৫ সালের পর নিবন্ধনবিহীন এবং ২০১৪ সালের পর নিবন্ধনসহ কোনো শিক্ষক ম্যানেজিং কমিটি নিয়োগ দিতে পারবে না। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান  প্রধান ও সহকারী প্রধান এবং স্টাফ নিয়োগ দিতে পারে। অথচ কালামের স্কুলে ২০১৮ সালে বসে ২০০১ সালে ৪জন শিক্ষককে  এমপিও নীতিমালা লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছে এবং তারা সরকারি বেতনও উত্তোলন করছেন। কীভাবে বেতন প্রদানকারী তিন স্তর বিশিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ বেতন দিলেন তা পরিষ্কার নয়। তবে তারা কোনোভাবেই বৈধ শিক্ষক নয়।
এরকম গরমিল ভুক্তভোগী শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে যেমন আছে তেমনি ২০১৯ ও ২০২২ সালে এমপিভুক্ত ৫৩৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আছে।

আমি কালাম সাহেবের এ সত্যটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য চ্যালেঞ্জ নিলাম।
মহাপরিচালক স্যারকে বিষয়টি বুঝালাম। স্যার বিষয়টি বুঝে আমাকে প্রস্তাব তৈরি করে সমস্যা সমাধানের লেআউট দিতে বললেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তাব দিয়ে সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বরাবর মহাপরিচালক, ব্যানবেইস ১৬ই জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ পত্র প্রেরণ করেন।

আমরা যুক্তি দেখালাম
এধরনের অবৈধ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা প্রশাসনের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে, সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অবৈধ অর্থের লেনদেন হচ্ছে, এনটিআরসিএ এর নিবন্ধনধারী শিক্ষকরা নিয়োগ পাচ্ছেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলাদলির কারণে কোর্টে এমপিও সংক্রান্ত মামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে সর্বোপরি শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে এবং সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এমপিও অনলাইনে দিয়েছে তাও ব্যর্থ হচ্ছে।

সমাধানের জন্য আমরা প্রস্তাব করলাম
২০১৩ সাল থেকে ব্যানবেইস সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের তথ্য অনলাইনে  সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছে।
নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন প্রদানের সময় যদি ব্যানবেইসে সংরক্ষিত ডাটাবেইজের সঙ্গে যাচাই করে বেতন প্রদান করা হয় তাহলে শিক্ষা প্রশাসনে সুশৃঙ্খলা ফিরে আসবে, সরকারের আর্থিক সাশ্রয় হবে, এনটিআরসিএ নিবন্ধনধারী যোগ্য শিক্ষকগণ নিয়োগ পাবেন, অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ হবে, কোর্টে এমপিও সংক্রান্ত মামলা কমবে, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে।

সচিব স্যার আমাদের প্রস্তাব সদয় বিবেচনা করে ৬ই এপ্রিল ২০২৩ সালে পরিপত্র জারি করেন এই মর্মে যে, এখন থেকে ব্যাকডেটের স্মারক ব্যবহার ও তারিখ ব্যবহার করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে না। এমনকি  এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে উপজলা/জেলা/আঞ্চলিক/অধিদপ্তর পর্যায়ে ২০১৩ সাল থেকে অনলাইনে ব্যানবেইস কর্তৃক সংগৃহীত  শিক্ষক ও কর্মচারীদের তথ্যের সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে বেতন প্রদান করতে হবে। পরিপত্র জারি করার পরপরই ব্যানবেইস সম্পূর্ণ বিনা খরচে  শিক্ষক ও কর্মচারীদের তথ্য অনলাইনে আপলোড করে দিলো। সরকারের একটি পয়সাও আমরা খরচ করিনি এ কাজে। সবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। একজন সংসদ সদস্য সরাসরি হুমকি দিলো। আমাকে দেখে নিবে এমন কি বিএনপি’র জামায়াতের শিক্ষকদের রক্ষা করার জন্য আমি ডিজি স্যারকে বুঝিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করেছি বলেও আমাকে অভিযুক্ত করেছে। আর এ পত্রের আলোকেই পরিপত্র জারি হলো। এখন আর তারা দলীয় লোক নিয়োগ দিতে পারবে না তাই আমার উপর ক্ষোভ ঝাড়লো।
এ পরিপত্র কালাম সাহেবদের জীবন রক্ষা করলো। কালাম সাহেবসহ সারা দেশের সকল নিপীড়িত শিক্ষকের ভ্যানগার্ড হলো এই পরিপত্র।

এর ফলাফল সারা দেশে শিক্ষা পরিবার আজ ভোগ করছে। দলমত নির্বিশেষে সকল বঞ্চিত শিক্ষকদের এই নিরাপত্তা আমাকে পুলকিত করবে আজীবন। রাষ্ট্রীয় সেবায় এইটুকু অবদান আমার ম্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
কালামে সাহেবের  নথি ৪৩ মাস পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত করে সমাধান করে বেতন প্রদানের নির্দেশনা দেয়। এ ৪৩ মাস কালাম সাহেবেকে নির্ঘুম যামিনী ডায়বেটিস প্রেসারসহ পিতৃবিয়োগ সবই উপহার দিয়েছে। একটা সত্যকে সত্য বলে মিথ্যার কাছে প্রতিষ্ঠা করতে হাজারটা জীবন্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও  ৪৩ মাস সময় লেগেছে আমাদের। এই ৪৩ মাসে সরকারের কতো কর্মঘণ্টা, অর্থ, ম্যানপাওয়ার, লজিস্টিক সাপোর্ট, সিস্টেম এমনকি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে তার জবাব কে দিবে? কে দায়ী এ জন্য? যে অবৈধ অর্থের লেন দেন হয়েছে তার দায়ভার কার? তারা কি আদৌও শাস্তির আওতায় আসবে? এ লজ্জা শিক্ষা পরিবারের সকল সদস্যের। আমরা এ দায় এড়াতে পারি না।

আজ কালাম সাহেবে নতুন জীবন পেয়েছে একটা দানবকে পরাজিত করে। এ রকম কালাম তো সারা দেশে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সব কয়টিতেই কমবেশি আছে। যারা ঢাকা চিনেন না। টাকা নেই। নেই কালাম সাহেবের মতো সাপোর্ট। তারা অসহায় হয়ে সব নিয়মিত পাওনা বলে মেনে নিয়েছে। আল্লাহ কাছে দু’হাত তুলে গভীর রাতে কাঁদে আর বলে আল্লাহ তুমি এ জালিমের বিচার করো। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ সাহায্যকারী নেই।
২০১৯ ও ২০২২ সালে আওয়ামী সরকার প্রায় ৫৩৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ করে। কালাম সাহেবের স্কুলের তথ্য অনুযায়ী গড়ে একটি প্রতিষ্ঠানে যদি ৪ জন শিক্ষক ও অবৈধ থাকে তাহলে ৫৩৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতোজন আছে এবং সরকারের কতো টাকা প্রতিমাসে ব্যয় হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। আর রাতারাতি শিক্ষক বনে যাওয়া এই শিক্ষকগণ একাডেমি কার্যক্রমে কতোটুকু ফিট তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষ।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা সংস্কারে কালাম সাহেবদের বিষয়ে সঠিক ও আকার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টার সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক: সহকারী পরিচালক (প্রশাসন), ব্যানবেইস

mzamin

No comments

Powered by Blogger.