পদত্যাগের হিড়িক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল গতকাল পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়াও সাতটি হলের প্রভোস্ট পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। শনিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। গত বছরের ৪ঠা নভেম্বর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের স্থানে ২৯তম ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। ভিসির পরপরই সাতটি হলের প্রভোস্ট পদত্যাগ করেছেন।
সেগুলো হলো- মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিজয় একাত্তর হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন নাহার হল। এর আগে গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালসহ প্রো-ভিসি (প্রশাসন ও শিক্ষা), প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, কোষাধ্যক্ষ, সব প্রভোস্টসহ সব সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্যদের পদত্যাগসহ দুই দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
শাবি প্রতিনিধি জানান, অবশেষে পদত্যাগ করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। শনিবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে ভিসি ফরিদের পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এর আগে ২০২২ সালেও ভিসি ফরিদের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল। তখন ক্যাম্পাসে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তখন তিনি আর পদত্যাগ করেননি। তৎকালীন সরকারও নেয়নি কোনো ব্যবস্থা।
চবি প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভিসি উপাচার্য, প্রো-ভিসি, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টদের পদত্যাগের দাবিতে গত দুই দিন থেকে আন্দোলন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চলমান আন্দোলনের মুখে এবার পদত্যাগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্যসহ তিনটি আবাসিক হলের হল প্রভোস্ট।
শনিবার পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চবি’র রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ। পদত্যাগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, আমি শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলমের নেতৃত্বে ১০ জন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া তিনটি আবাসিক হল আলাওল হলের প্রভোস্ট সৃজিত কুমার দত্ত, এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট আলী আরশাদ চৌধুরী এবং সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট শেখ সাদি পদত্যাগ করেছেন। তবে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কারও পদত্যাগপত্র হাতে পাইনি।
নোবিপ্রবিতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ, প্রক্টরসহ ৯ জনের পদত্যাগ, ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা: নোয়াখালী থেকে স্টাফ রিপোর্টার ও নোবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আল্টিমেটামের নির্ধারিত ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। পদত্যাগ করা কর্মকর্তারা হলেন- প্রক্টর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক বিপ্লব মল্লিক, ভাষাশহীদ আবদুস সালাম হলের প্রভোস্ট কাউসার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উকিল হলের প্রভোস্ট রুহুল আমিন, হযরত বিবি খাদিজা হলের প্রভোস্ট মো. রফিকুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অবন্তী বড়ুয়া, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট মুহাম্মদ মহিনুজ্জামান, আইকিউএসি’র পরিচালক অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও অতিরিক্ত পরিচালক মোহাইমেনুল ইসলাম। শুক্রবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্ট বোর্ডের একটি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জানা যায়, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী পদত্যাগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, পাঁচটি আবাসিক হলের প্রভোস্টসহ নয়জন। গতকাল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও রেজিস্ট্রার বরাবর তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন। রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেয়া, সোমবার থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু এবং ২৫শে আগস্ট থেকে সশরীরে ক্লাস শুরু হবে। রেজিস্ট্রার মো. জসীম উদ্দিন পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে মানবজমিনকে জানান, পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বিষয়টি ভিসিকে জানানো হয়েছে।
গত বুধবার ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রক্টরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তা এবং প্রভোস্টদের নোবিপ্রবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ দাবি করে বিবৃতি দেন। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের এক জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দেয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করায় নোবিপ্রবি ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি এবং রেজিস্ট্রারকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নোবিপ্রবি’র সমন্বয়কবৃন্দ।
এর আগেও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ পদত্যাগ করেন। গত বুধবার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভিসি অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। তিনি প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে ই-মেইলে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
একই দিন পদত্যাগ করেছেন জাবি’র রেজিস্ট্রার (চুক্তিভিত্তিক) আবু হাসান। এ ছাড়া, জাবিতে একাধারে পদত্যাগ করেছেন প্রক্টর ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আলমগীর কবির এবং ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ছায়েদুল ইসলাম। তাদের পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টর হিসেবে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রুবেল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ হলের প্রভোস্ট হিসেবে সহযোগী অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার ও ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রভোস্ট হিসেবে অধ্যাপক আফসানা হককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ভিসি অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ পদত্যাগ করে প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। গত শুক্রবার তিনি পদত্যাগ করেন। এদিন সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের জন্য ১২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ভিসি অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম, প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান ও ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভুঁইয়া পদত্যাগ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার তারা ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষা সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। পদত্যাগপত্রে তারা ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করেছেন বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, প্রোভিসি অধ্যাপক ড. অলক কুমার পাল ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশীদ। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কগণ কর্তৃক তাদের পদত্যাগের জন্য তিন ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, প্রক্টর আসাবুল হক, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদসহ প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। গত বৃহস্পতিবার তারা পদত্যাগ করেন। শিক্ষার্থী ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এরপর এদিন রাতে পদত্যাগ করেন প্রো-ভিসি অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম (প্রশাসন) ও অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর (শিক্ষা) পদত্যাগ করেন।
প্রক্টর, দুই অনুষদের ডিন এবং বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্টকে অব্যাহতি প্রদান এবং পদগুলোতে নতুনভাবে পদায়ন করেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়।
এদিকে প্রশাসনিকভাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম সিন্ডিকেট সভা শেষে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জানান প্রোভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক কার্যবিধি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
No comments