জন্ম রাস্তায়, বিক্রির পর নিরুদ্দেশ শিশুরা by মিফতাহুল জান্নাত

নাম লিমা। পেশায় যৌনকর্মী। তিন বছর আগে বিয়ে হয় এক অটোচালকের সঙ্গে। থাকতেন ঢাকার একটি কেন্দ্রীয় এলাকায়। সেখানেই পরিচয় হয় শারমিন নামের এক মহিলার সঙ্গে। তিনিই প্রস্তাব দেন সন্তান কেনার জন্য। এর পরেই রাস্তায় সদ্য জন্ম নেয়া ৭ দিনের ছেলে সন্তানকে বিক্রি করে দেন লিমা। স্বামীর সঙ্গে থাকলেও সন্তান পালনের সামর্থ্য নেই বলে দাবি তাদের। এর আগেও দুটি সন্তান বিক্রি করেছেন লিমা। বলেছেন, আগের স্বামীর চিকিৎসার খরচের জন্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাদের ফোন নাম্বার ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। শুনেছেন বিদেশে নিয়ে গেছে বাচ্চাগুলোকে। সেখানেই বড় হচ্ছে। তাদের দেয়া ফোন নাম্বারে কল দিলে নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
১৫ বছর বয়সী ফাতেমা আক্তার। থাকেন একই এলাকায়। সেখানেই এক কম বয়সী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে দাবি কিশোরীর।

ফাতেমা এখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য যে টাকা প্রয়োজন সেই সামর্থ্য নেই তার। সে কারণেই সন্তান বিক্রির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অনেকের সঙ্গেই ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দর কষাকষিও করেছেন।
৪০ বছর বয়সী শাহিনুর। পেশায় যৌনকর্মী। ৭ বছর বয়সে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হয় তাকে। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে ঢাকায় আসেন। মাথাগোঁজার ঠাঁই মেলে রাজধানীর ফুটপাথেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন যৌনকর্মীর। এ অবস্থায় পরপর তিনটি সন্তান বিক্রি করেছেন শাহিনুর। বলেছেন, সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে পারবেন না, মানুষ করতে পারবেন না। তাই নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে ভালো পরিবার দেয়ার আশায় বিক্রি করেছেন। কাদের কাছে বাচ্চা বিক্রি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, কিছু লোক আছে যারা নিজেরাই এসে জিজ্ঞেস করেন বাচ্চা বিক্রি করবে কিনা? তাদের কাছেই ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন। তবে নিঃসন্তান পরিবারের কাছেই সন্তানগুলো পৌঁছেছে বলে দাবি শাহিনুরের।
এর পেছনে কোনো চক্র আছে কিনা জানতে চাওয়া হয় পথবাসী নারীদের অধিকার ও আশ্রয় নিয়ে কাজ করা কল্যাণময়ী নারী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রিনা আক্তারের কাছে। তার নিজের জীবনও কঠিন সংগ্রামের। বলেছেন, সদরঘাট, গুলিস্তান, মুগদা, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী এলাকাগুলোতে কিছু দালাল চক্র আছে যারা কমবয়সী পথবাসী নারীগুলোকে ভালোবাসা দিয়ে কাছে রাখে। রাখার পরে তাদের দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া দেয়। পরে বাচ্চা হওয়ার পরে বাচ্চা নিয়ে চলে যায়। এরপরে তারা জানানও না যে, বাচ্চাগুলো কোথায় দিয়েছে।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা হাজেরা বেগম। নিজেও ঢাকার রাজপথেই বড় হয়েছেন। বর্তমানে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালাচ্ছেন। সেখানে এককালীন ৪০ জনের বেশি শিশু বড় হচ্ছে। যারা সকলেই পথবাসী নারীর সন্তান। এসব বাচ্চার বিক্রি নিয়ে হাজেরা বলেছেন,  অনেক যৌনকর্মী রাস্তায় বাচ্চা পালতে পারে না, অনেক সময় চুরি হয়ে যায়। যেসব চক্র চুরি করে তারা পাচার করে দেয় নয়তো বিভিন্ন জায়গায় দিয়ে দেয়। যার খোঁজ মায়েদের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, আবার অনেকেই বাচ্চাদের নিজের কাছে রেখে ভিক্ষাবৃত্তিও করাচ্ছেন।
এভাবে সন্তান বিক্রি অপরাধ হলেও এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিষয়টি স্বাভাবিক। এ নিয়ে এক পথবাসী নারী বলেন, বাচ্চা বিক্রি করা একটা পেশা, টাকা পাওয়া যায়। শুধু আমি না অনেকেই করে।
সাকির ইব্রাহীম মাটি। গুলিস্তান এলাকায় ‘পথের স্কুল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালায়। যেখানে পথবাসী নারীদের সন্তানদেরকে প্রতিদিন বিকালে পড়াশোনা করান। ৯ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চালান মাটি। তিনি জানান, এই নয় বছরের অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি এসব নারীরা বাচ্চা বিক্রি পেশা হিসেবে নিয়েছে। তারা ভাবে যত বেশি সন্তান জন্ম, তত বেশি টাকা।
এসব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অনেক পথবাসী মা আছেন যারা সন্তানদের লালনপালন করতে না পারায় সন্তান বিক্রির যে চক্র তাদের খুঁজে বের করে নিজেরাই বিক্রি করে দেন।  একটি ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে যখন ভাসমান নারীদের গর্ভে কোনো সন্তান থাকে। এই প্রতারক চক্র তাদেরকে খুঁজে বের করে সে নারীদের খাবার, বস্ত্র  ও চিকিৎসা প্রদান করে। খরচ বহন করেন যাতে সন্তানটি সুস্থ থাকে। সন্তান জন্ম দেয়ার পর আর খোঁজ থাকে না। সন্তান নিয়ে চক্রটি চলে যায়। সময় এসেছে এই অপরাধগুলোর সঙ্গে যে চক্র জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে সমস্যা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

No comments

Powered by Blogger.