দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধ: প্রত্যাশা কি বাংলাদেশে ঘৃণাকে দমাতে পারবে?
সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা আংশিকভাবে কঠিন হবে। কারণ শেখ হাসিনার আকস্মিক পদত্যাগে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কে পূরণ করবে তা স্পষ্ট নয়। তার আওয়ামী লীগ দল এমনিতেই দেশে সমালোচিত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সাথে পালাক্রমে আধিপত্য বিস্তার করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া এখন জেল থেকে মুক্ত। কিন্তু তার বয়স এখন ৭৮। তিনি নিজেও অসুস্থ। শেখ হাসিনার ক্রমাগত দমনপীড়নে বিএনপি কার্যত বিপর্যস্ত। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ববাদী শাসন নতুন অধিক উদারপন্থি দলের উত্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামপন্থী দলগুলো যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো শক্তিশালী হয়েছে, তারা শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইতে পারে। চ্যালেঞ্জটা বেশ কঠিন। কারণ বাংলাদেশ এখন চীন, ভারত এবং পশ্চিমের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র।
প্রাথমিক কিছু লক্ষণ বেশ আশাব্যঞ্জক। শেখ হাসিনা ভারতে গা ঢাকা দেবার পর সেনাবাহিনী সংযম দেখিয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একই দিনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে আনার জন্য ড. ইউনূসের নাম উল্লেখ করেন। ড. ইউনূসের প্রথম কাজই হলো দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসুরিদের জন্য শতকরা ৩০ ভাগ আসন সংরক্ষণের বিরুদ্ধে এই কোটা আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের যুক্তি ছিল যে এই সিস্টেম প্রধানত আওয়ামী লীগের সদস্যদের উপকৃত করেছে । সরকার বিক্ষোভকারীদের দমনের চেষ্টা করেছে। শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আদালত যখন শেষ পর্যন্ত কোটা বাতিল করে, তার আগে থেকেই বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে বছরের পর বছর মানুষের মনে জমে থাকা হতাশা ক্ষোভে পরিণত হয়। প্রতিবাদকারীদের ক্ষোভ এতটাই তীব্র ছিল যে, তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বাসভবন, থানা ও বাসায় হামলা করে। ড. ইউনূস চলমান অস্থিরতার ঝুঁকি স্পষ্টভাবে স্বীকার করে জনগণকে বলেন, শান্ত থাকুন এবং আপনার চারপাশের লোকদের শান্ত থাকতে সাহায্য করুন'।
ড. ইউনূসের পরবর্তী অগ্রাধিকার হবে বাংলাদেশের রাজনীতির পুনর্গঠন। দ্রুত নতুন নির্বাচন সংঘটিত করার চেয়েও এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ । দেশের আদালত এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে অশান্তির উৎস— সেই প্রভাব কমাতে হবে। রাজনীতিতে আসা তরুণ শক্তিকে নিজেদের সংগঠিত করার জন্য সময় ও সুযোগ দিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলি ছাড়া, একটি নতুন নির্বাচন সহজেই ইসলামপন্থী দল বা পুনর্গঠিত বিএনপির হাতে চলে যেতে পারে। ড. ইউনূসের জন্য তৃতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হল একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ নেভিগেট করা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের দিক থেকে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, তারা আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে দেখে এসেছে। গত দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক ভারত শেখ হাসিনার সঙ্গে বাণিজ্য, জ্বালানি ও সামরিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত করেছে। এখন ভারত, আয়রন লেডিকে ( শেখ হাসিনা ) আতিথেয়তা প্রদান করে প্রতিকূলতার মুখোমুখি বাংলাদেশি জনসাধারণের অনেকেই ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের ওপর ১০,০০০ ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য চাপ যেমন রয়েছে তেমনি বাংলাদেশে ১৪ মিলিয়ন হিন্দুর বসবাস।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং যে কোনো উত্তরসূরি আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তার জন্য শেখ হাসিনার চেয়েও চীনের দিকে বেশি ঝুঁকতে পারে। হাসিনার শাসনামলে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার, এর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী, তৃতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা এবং সামরিক প্রযুক্তির প্রধান উৎস হয়ে ওঠে। তবুও চীনের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হওয়া এড়াতে হাসিনা ভারত এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন ।
আত্মতৃপ্তি সবথেকে বড় দুশ্চিন্তার কারণ
বাংলাদেশের সংকট আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা সরকারের কাছেও উদ্বেগজনক। তারা দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা ও ইসলামিকরণ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রত্যক্ষ করে এসেছে। ২০০৮ সালের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর বাংলাদেশে একটি আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা ও বৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। পশ্চিমা সরকারগুলি এটিকে কিছু সময়ের জন্য একটি আঞ্চলিক সাফল্যের গল্প হিসাবে দেখেছিল, দেশের প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ এবং সমৃদ্ধ পোশাক শিল্পের প্রশংসা করেছিল। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার হ্রাস পেয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ জনপ্রতি জিডিপি (বাজার মূল্যে) এবং শ্রম খাতে নারীর অংশগ্রহণ সহ বাংলাদেশ বেশ কিছু সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত এক দশকে সেই আশা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার অঙ্গুলি হেলনে একের পর এক নির্বাচনে কারচুপি চলতে থাকে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া (যিনি দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন)সহ শত শত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি কারাগারে পাঠান।
বিশেষ করে আমেরিকা, শেখ হাসিনার আচরণের স্পষ্ট সমালোচক হয়ে ওঠে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিজাত বাংলাদেশি র্যাবের উপর ২০২১ সালে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২৪ সালে প্রাক্তন সেনাপ্রধানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তা সত্ত্বেও, পশ্চিমা সরকারগুলি শেখ হাসিনার সরকারের উপর কোনো ভারী জরিমানা আরোপ করা এড়িয়ে যায় । এটি আংশিকভাবে চীন সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কারণে ছিল, কারণ উন্নয়নশীল বিশ্বে চীন তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তাই গণতান্ত্রিক রেকর্ড নিয়ে সমালোচনা থাকলেও পশ্চিমা হস্তক্ষেপ সম্পর্কে স্পর্শকাতর ভারতের সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হবার এটাও একটি কারণ।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা এখনও বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪.৭ বিলিয়ন বেল-আউটের মাঝামাঝি স্তরে রয়েছে বাংলাদেশ। (যেখানে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আছে)। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা তার রপ্তানির জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অনুপস্থিতির কারণে ২০২৯ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ধাক্কা খেতে পারে। জাপানেরও প্রভাব আছে বাংলাদেশের ওপর, কারণ তারাও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাহায্য দাতা। চীন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাথে তার অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে, ইতিমধ্যেই বিএনপি এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনসাধারণের মধ্যে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে। বিদেশী মুদ্রার মজুত বাড়াতে চীন স্বল্পমেয়াদী আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিতে পারে (জুলাইয়ে চীন সফরে গিয়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছেন শেখ হাসিনা ) পাশাপাশি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করতে পারে চীন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। যা ২০০৯ সালে ৩.৬ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। (বেশিরভাগই চীনা রপ্তানির জন্য)।
তবুও, চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার জেরে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে যুক্ত ঋণের পরিমাণ কমানো হয়েছে। পাকিস্তানের প্রকল্পগুলিতে চীনা শ্রমিকদের উপর ধারাবাহিক হামলার পর, চীনা কর্তৃপক্ষও বাংলাদেশের সরকার গঠন নিয়ে আগ্রহ হারাতে পারে, বিশেষ করে যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইসলামপন্থী সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত সব দেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে স্থিতিশীলতা। আশার কথা হলো, সামনের দিকে তাকিয়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সহাবস্থানে থাকার একটি উপায় খুঁজে বের করতে পারে। যেমনটা শ্রীলংকা সরকারের পতনের পর দেখা গেছে। কিন্তু মহাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই তীব্র হয়, ততই ঝুঁকি বাড়ে। এমনকি এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবার পুনর্গঠন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি এটি শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
No comments