রাইড শেয়ারিং: খেপে আগ্রহ বাড়ছে by মারুফ কিবরিয়া

শনিবার ৭ই সেপ্টেম্বর, সকাল ১১টা। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের সামনে কিছু মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে দেখা গেল, দুই ব্যক্তির মধ্যে বাকবিতণ্ডা চলছে। ক্ষাণিক সময়ের মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো তাদের কথা কাটাকাটি। একে অপরের মারমুখী
অবস্থান। তবে সে পর্যন্ত যাওয়ার আগে কিছুটা সামলে নিয়েছেন তারা। জানা গেল আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকাদের একজনের কাছ থেকে। তিনি জানান, এক মোটরসাইকেল চালক যাত্রীকে ‘কই যাবেন’ বলে ডাকাডাকি করছিলেন। বিষয়টি ভালো লাগেনি ওই যাত্রীর। রাইড শেয়ারের অ্যাপস সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও ‘ডাকাডাকি’ কেন এ নিয়ে যাত্রী মোটরসাইকেল চালকের ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন। একপর্যায়ে দুজনই ক্ষেপে ওঠেন। তবে ওই বাসস্ট্যান্ডেই কিছু রাইডারকে দেখা গেল সমঝোতার মাধ্যমেই যাত্রীদের চুক্তির ভিত্তিতে রাইড শেয়ার করছেন।
বছর তিনেক আগে রাজধানীতে রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। পাঠাও, উবার, সহজ ও ওভাইসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রাইড শেয়ারিং শুরু করে। ঢাকায় যানজটে নাকাল বাসিন্দারা এই সুবিধা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘ সময় বাসের অপেক্ষা না করে হাতে থাকা মুঠোফোনে রাইড শেয়ারিংয়ের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসের মাধ্যমে মোটরসাইকেল খুঁজে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পেরে বেশ সন্তোষ। স্বল্প সময়ের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় এই সুবিধা। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রশংসার স্থলে নিন্দা করতেও দ্বিধা করেননি সাধারণ মানুষ। সুন্দর প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ তুলছেন অনেক যাত্রী।
মোটরসাইকেল চালকরা অ্যাপসে নয়, খেপেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। শহরের প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা রিকশার মতো সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী ডাকাডাকি চলছেই তাদের। যে অ্যাপসের কারণে মোটরসাইকেল চালিয়ে উপার্জন করছেন সেটা বন্ধ রেখে চুক্তির ভিত্তিতে যাত্রী বহন করছেন রাইডাররা। এসব নিয়ে অভিযোগের যেমন শেষ নেই তেমনি ঘটছেও নানা দুর্ঘটনা। বিশেষ করে সম্প্রতি মালিবাগ ফ্লাইওভারে এক রাইডার ছিনতাইকারীর হাতে খুন হওয়ার পরও টনক নড়েনি তাদের। রাজধানীর কোনো না কোনো স্পটে গেলে কারো হাতে মোবাইল দেখামাত্র কিংবা যাত্রীর মতো দেখলেই শুরু করেন ডাকাডাকি।
তবে, অ্যাপসের মাধ্যমে নিত্য চলাচল করা যাত্রীদের অভিযোগ, এই ডাকাডাকির ব্যাপারটি খুবই বিরক্তির। মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করার প্রক্রিয়া শুধুমাত্র অ্যাপের মাধ্যমে। আর সেটা যদি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা রিকশার যাত্রী বহনের পর্যায়ে চলে যায় তবে সেটা দুঃখজনক। অনেকে বিষয়টিকে অশনিসংকেত বলেও মনে করছেন। রাজধানীতে নিয়মিত অ্যাপসের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে চড়েন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোর্শেদ হোসেন। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন নতুন বাজার থেকে মিরপুর অফিসে আসা যাওয়া করি। বাসে ওঠানামা ঝামেলা হওয়ায় রাইড শেয়ারিং সুবিধা নিচ্ছি এটি আসার পর থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখন রাইডারদের অনেকেই অ্যাপস অফলাইনে গিয়ে চুক্তিতে যাত্রী তোলেন। যা খুবই বিরক্তির। মেইন রোডে উঠে দাঁড়াতেই রিকশাওয়ালার মতো জিজ্ঞাস করতে থাকেন ‘ভাই কই যাবেন’। তখন নিজের কাছে খুব লজ্জা লাগে। আমরা এত সুন্দর একটা সিস্টেম ধরে রাখতে পারলাম না।
শহীদ উদ্দিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, অ্যাপসেই তো রাইড শেয়ারিংয়ের সিস্টেম। কিন্তু এখন বাইকওয়ালারা ডাকাডাকি করে। চুক্তিতে চালানোর জন্য তাদের আইনগত বৈধতা আছে কিনা সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি না থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারওয়ান বাজার থেকে প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেই মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে বাইক চালকরা। সবাই- কই যাবেন কই যাবেন বলে চিৎকার করে। এটা কেমন ব্যবহার! আমার কাছে অবাক লাগে। মোটরসাইকেল তো ডাকাডাকি করার কথা না। অ্যাপের মাধ্যমে কল দিলে তবেই আমি কোথাও যেতে পারবো।
এদিকে অ্যাপ ছাড়া মোটরসাইকেলে চলাচল করেন এমন এক যাত্রী শরীফ বলেন, মোবাইলে সব ব্যবস্থাই আছে। সব অ্যাপস ডাউনলোড করা। কিন্তু ইচ্ছা করে না। একে তো রাইডার পেতে সময় লাগে। তারওপর ভাড়া বেশি দেখায়। আবার অনেক সময় ‘সার্চ’ করতে করতে আর পাওয়াই যায় না। এজন্য অ্যাপস বাদ দিয়ে চুক্তিতে চলে যাই। চুক্তিতে যাওয়া ঝুুঁকিপূর্ণ জেনেও এই যাত্রী আরো বলেন, দুর্ঘটনা তো ঘটেই। সেটা জানি। কিন্তু জরুরি সময়গুলোতে অ্যাপসে নেটওয়ার্ক বিজি দেখানোর কারণে ঝুঁকি নিয়েই চলে যাই।
অবশ্য রাইডাররা বলছেন, ভিন্ন কথা। বেশকিছু রাইডারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডাকাডাকির কারণ অন্য। অনেক সময় যাত্রীদের মোবাইলে চার্জ থাকে না, কারও অ্যাপস থাকে না আবার কারো চলতি পথেই ডাটা শেষ হয়ে যায়। এসব কারণেই ডেকে জিজ্ঞাস করেন, কোথাও যাবেন কিনা! এছাড়া কিছু রাইডার ইচ্ছাকৃত চুক্তিতে চলেন বলে জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, অ্যাপে আসা ভাড়া তাদের চাহিদার তুলনায় বেশ কম। তার মধ্যে কোনো যাত্রীর যদি প্রমোশনাল ডিসকাউন্ট থাকে তাতে একটি রাইড শেয়ার করে এক লিটার তেলের টাকাও পান না। তাই অ্যাপস বন্ধ করে চুক্তিতে রাইড শেয়ার করেন।
আমীর হোসেন নামের এক রাইডার বলেন, আমার কিছুদিন আগে একটি চাকরি ছিল। সেটি চলে গেছে। এখন পরিবার চালানোর জন্য রাইড শেয়ার করি। অ্যাপস যাত্রী নিলেও সেটা কম। চুক্তিতে নেয়ার কয়েকটি কারণ। তারমধ্যে প্রধান হলো, অনেক যাত্রীর ডিসকাউন্ট থাকে। তখন আমার এক লিটার তেলও কেনার টাকা হয় না। তাই যাত্রী ডাকাডাকি করি। তিনি আরো বলেন, এটা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে। যাত্রীদের অনেকের মোবাইলে চার্জ থাকে না বা ডাটা শেষ হয়ে যায়। তখন যাত্রীরাই আমাদের কাছে আসেন।
চুক্তিতে রাইড শেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও নিয়মিত সেটাই করছেন আরিফ হোসেন নামের আরেক রাইডার। তিনি বলেন, ঝুঁকি তো আছেই। কিছুদিন আগেও একটা মার্ডার হইছে। কিন্তু কি করবো। মাঝে মাঝে পরিস্থিতির শিকার হয়ে চুক্তিতে যাত্রী নিয়ে যেতে হয়।
এসব ব্যাপারে পাঠাওয়ের হেড অব মার্কেটিং নাবিলা মাহবুব মানবজমিনকে বলেন, চুক্তিতে অনেক রাইডারের রাইড শেয়ারিংয়ের বিষয়টি পরোক্ষ অভিযোগ পেয়েছি। তবে আমরা নিয়মিত রাইডারদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করছি। তারা যেন চুক্তিভিত্তিক যাত্রী না নেন, সেসব ব্যাপারে অনেক সচেতন আমরা। যাত্রীদেরও এসব ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তিনি আরো জানান, রাইড শেয়ারিং নিয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা চলছে। পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে ইতিমধ্যে। আমরাও তাদের সঙ্গে কাজ করবো।

No comments

Powered by Blogger.