মরণোত্তর চক্ষুদান: বেশি কর্নিয়া আসছে অনিবন্ধিতদের by মরিয়ম চম্পা

টুনটুনি জন্মের পর থেকেই পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি। দেখা হয়নি মায়ের চাঁদ মুখটি। এভাবেই কেটে যায় ১৮ বছর। ১৯৮৪ সালে তার চোখে আলো নিয়ে আসে সন্ধানী। অন্যের দান করা কর্নিয়ায় টুনটুনি   ফিরে পায় দৃষ্টিশক্তি। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর তার মাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে সে। এটি দেশে প্রথম চোখে কর্নিয়া সংযোজনের ঘটনা। মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথপ্রদর্শক শ্রীলঙ্কার চিকিৎসক ডা. হাডসন সিলভারের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ লোক অন্ধত্বে ভুগছে। এরমধ্যে প্রায় ৫ লাখ লোক কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বে ভুগছে। প্রতি বছর আরও নতুন করে যোগ হচ্ছে ৪০ হাজার। তবে দেশে যে পরিমান কর্নিয়া সংগ্রহ হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগন্য। মরণোত্তর চক্ষুদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এলে ভবিষ্যতে অনেকের চোখের আলো ফিরিয়ে দেয়া যাবে মরনোত্তর চক্ষু দানের মাধ্যমে। চিকিৎসক, চিকিৎসা বিদ্যার শিক্ষার্থী এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। ১৯৮৭ সাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (বহির্বিভাগ) এর কাজ শুরু হয়। বর্তমানে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজসহ ৯টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯টি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (বহির্বিভাগ) কেন্দ্রীয় অফিসসহ মোট ১০টি চক্ষুব্যাংকে কার্যক্রম চালু রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সন্ধানী এ পর্যন্ত তিন হাজার ৩৮২টি কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পেরেছে। এর মধ্যে তিন হাজার ২১১টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে প্রকৃত দাতার সংখ্যা মাত্র ১০২ জন। বাকি কর্নিয়াগুলো বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মরণোত্তর কর্নিয়া দানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাংবাদিক ও লেখক কামাল লোহানি, অভিনেত্রী সারা যাকের, সুবর্ণা মুস্তাফা, কণ্ঠশিল্পী মেহরীন, কৃষ্ণকলি প্রমুখ।
প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, ড. আলীম আল রাজী, অধ্যাপক ড. আহমেদ শরীফ, সন্ধানী চক্ষুদান সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর হাসনা বেগম, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন, চক্ষু বিশেষজ্ঞ এ এইচ সাইদুর রহমান, সন্ধানীর সাবেক মহাসচিব ডা. বাবুল চন্দ্র দে শিশির চক্ষুদান করে অন্যের চোখে আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন কর্নিয়া সমস্যায়। তিনি এক চোখে দেখতে পান না বললেই চলে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা গেলে তিনি আবার দেখতে পাবেন। কিন্তু কাঙ্খিত কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। কখন পাওয়া যাবে, তাও অনিশ্চিত। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিজেকে এত অসহায় লাগছে, যা প্রকাশ করা যায় না। একটি কর্নিয়ার জন্য আমার এক চোখ অন্ধ হয়ে আছে। আর এমন অসহায়ত্ব থেকেই আমি আমার ভালো চোখটিকে দান করে রেখেছি।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর জন্য তাঁর পরিবার প্রায় তিন বছর ধরে দেশের বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ঘুরছেন। কিন্তু সবার একই কথা, কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওই ছাত্রীর বাবা বলেন, শুধু আমার মেয়েই নয়, কর্নিয়ার জন্য তো রীতিমতো হাহাকার অবস্থা। বাবা হয়ে মেয়ের জন্য একটি কর্নিয়া সংগ্রহ করে দিতে পারছি না, এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কী হতে পারে। এখন ভাবছি, আর কয়েক দিন অপেক্ষা করে যদি না মেলাতে পারি, তবে নিজেরই একটি চোখ মেয়েকে দিয়ে দেব।
চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে কর্নিয়া সংগ্রহের জন্য আগে পুরো চোখ তুলে ফেলতে হতো। এখন কেবল কর্নিয়াটুকু তুলে যত্নসহকারে সেলাই করে দিলেই হয়ে যায়। এতে মৃতদেহের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও চাহিদা অনুসারে কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এর জন্য মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালে প্রণীত আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ ওই আইনের ধারা ৪-এ দাতার মৃতদেহ থেকে ব্রেইন ডেথ ঘোষণার পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের বিধান আছে। যা কর্নিয়া সংগ্রহের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে স্বাভাবিক মৃত্যু বা বায়োলজিক্যাল ডেথ হওয়ার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে চোখ বা কর্নিয়া সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে হয়। অথচ ১৯৯৯ সালের ওই আইন অনুযায়ী মৃত্যু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি কেউ মৃতদেহ দাবি না করে তাহলে কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি নিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিধান অনুসারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাউকে বেওয়ারিশ ঘোষণা করা যাচ্ছে না। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত বেওয়ারিশ মৃতদেহ থেকেই সবচেয়ে বেশি চোখ বা কর্নিয়া সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মরণোত্তর চক্ষুদাতার ক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টা এবং বেওয়ারিশ হলে সেই ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা পর মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ব্রেইন ডেথ ঘোষণা সাপেক্ষে চোখ সংগ্রহ করে কর্নিয়া সংযোজন করলে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাবে না।
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে এম সালেক বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণরা এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কাজেই এখন যারা চক্ষুদানের জন্য অঙ্গীকারনামায় চুক্তি বা সাক্ষর করছে তাদের চোখের কর্নিয়া পেতে গড়ে আরো ৩৫ থেকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের কারণে এখন আমাদের দেশে প্রায় পাঁচ লাখ লোক চোখের জন্য অপেক্ষা করছে। বছরে আমরা সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ১শ টি কর্নিয়া পেয়ে থাকি। যেটা দিয়ে কর্নিয়া সমস্যা সমাধান করতে গেলে আমাদের আরো শত বছর সময় লাগবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলেন, মরণোত্তর অঙ্গদান, চক্ষুদান, জীবিত অবস্থায় রক্তদান এগুলো প্রয়োজনের খাতিরে আমাদের ধর্মে বৈধ করা হয়েছে।  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, এটা একটি চমৎকার উদ্যোগ হতে পারে। এটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আছে। কাজেই এ বিষয়ে সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারি, বেসরকারি, ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে সবাই মিলে কিছু করলে আস্তে আস্তে এটা ব্যপ্তি লাভ করবে।
বাংলাদেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে যেকোনো বয়সের ব্যক্তির মরণোত্তর চক্ষুদান এবং মৃত্যুর পর তাঁর কোনো উত্তরাধিকারের লিখিত অনুমতি-সাপেক্ষে চক্ষু সংগ্রহের বিধান রয়েছে। সৌদি আরব, ইরান, কুয়েতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মৃত্যুর পর মৃতদেহ থেকে অঙ্গ সংগ্রহ করে অন্য জীবিত দেহে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অসংখ্য রোগীর চোখে আলো ফিরিয়ে দিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে। ইরানের মতো রক্ষণশীল দেশেও প্রতি বছর সাত হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন হচ্ছে।
সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষুদান সমিতির মতে, দেশের একমাত্র মানবচক্ষু সরবরাহের প্রতিষ্ঠান সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং প্রত্যান্ত অঞ্চলের চক্ষু বিশেষজ্ঞ সার্জন কর্তৃক প্রেরিত কর্নিয়ার রোগীদের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারবদ্ধ দাতা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেওয়ারিশ ও গ্রিফ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে কর্নিয়া সংগ্রহ করে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য সরবরাহ করা হয়। এ পর্যন্ত মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তির সংখ্যা ৩৬ হাজার ৯শ ৫৬ জন। এর মধ্যে থেকে ১২০ জন প্রকৃত দাতা বা রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তির কাছ থেকে তাদের কর্নিয়া পাওয়া গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত রোগীর স্বজনদের কাউন্সিলিং করে ৪২ জন ব্যক্তির কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এবং সফলভাবে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ৩ হাজার ৪শ ১৪টি। ২০১৯ সালের মার্চে সন্ধানীর চক্ষু হাসপাতালের ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্নিয়া প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছে ৬ হাজার ৫৮ জন। মোট সংগ্রহ ৪ হাজার ৫২ টি। দাতা ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহকরা কর্নিয়ার সংখ্যা ৩ হাজার ৪শ ১৪টি। এখন পর্যন্ত কর্নিয়া পেতে অপেক্ষায় আছেন ২ হাজার ৬শ ৪৪ জন ব্যক্তি।   
কর্নিয়া সংকটের মুখে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ইউনিটটি। ২০২০ সালের মধ্যে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে হলে প্রতিবছর অন্তত ৩০ হাজার কর্নিয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই বিপুলসংখ্যক কর্নিয়া পাওয়া তখনই সম্ভব হবে, যখন মানুষ মরণোত্তর চক্ষুদানে উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশের আইনে অন্ধত্ব মোচন (চক্ষুদান) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ তে বলা আছে, একজন ব্যাক্তি জীবিত অবস্থায় তার চোখ দুটি মৃত্যুর পর সংগ্রহের জন্য অনুমতি দিতে পারে। এমনকি জীবিত অবস্থাতেও কেউ তার চোখ সংস্থাপনের জন্য শর্তসাপেক্ষে দান করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে একটি মাত্র চক্ষুদান করতে পারবেন। মক্কাভিত্তিক ইসলামি ফিকাহ একাডেমী বলেছে, মরণোত্তর অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বা সংস্থাপন শরীয়ত বিরোধী নয়।

No comments

Powered by Blogger.