বালুচ লিবারেশন আর্মিকে কেন সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিলো যুক্তরাষ্ট্র! by উমাইর জামাল

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের (এফটিও) তালিকায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত বালুচ লিবারেশন আর্মিকে (বিএলএ) অন্তর্ভুক্ত করা অনেকটাই নজিরবিহীন অগ্রগতি। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন মূলত পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে তৎপর। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ঘোষণায় বলা হয়, ‘এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পাকিস্তানের মূলত বালুচ জাতিগত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক লোকজনকে টার্গেট করছে।’
কয়েক মাস আগে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধেই নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছিলো ওয়াশিংটন। তাহলে পাকি-মার্কিন সম্পর্কে এই বাঁক বদলের পেছনে রহস্য কি?
এটা ঠিক, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক পরিবেশ উন্নত করতে নেয়া একাধিক পদক্ষেপের ফল এই উদ্যোগ।
আফগান শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে দুই দেশের সহযোগিতা ও সংঘাত সৃষ্টি হলেও আফগান সমস্যা পাল্টে যাওয়ায় পাকিস্তান ও ওয়াশিংটনের মধ্যেও সমস্যার ধরনটি বদলে যেতে পারে। অন্যদিকে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার আশায় শান্তির হাত বাড়িয়ে দিতে পারে ওয়াশিংটন।
এমনও হতে পারে যে আফগান ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে কোন ধরনের চুক্তি হয়েছে। এ করণে বিএলএ-কে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করা হয়। কারণ বালুচিস্তান প্রদেশে সক্রিয় গ্রুপটির ব্যাপারে পাকিস্তান খুবই স্পর্শকাতর। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে বিএলএ-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় এর বিরুদ্ধে দমন অভিযান পরিচালনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক বৈধতা পেলো। এখন সংগঠনটির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে পাকিস্তান সন্ত্রাসদমন অভিযান জোরদার করবে বলে ধারণা করা যায়।
পাকিস্তান মনে করে আফগানিস্তান থেকে বিএলএ সহায়তা পাচ্ছে। এরা শুধু বালুচিস্তান প্রদেশকেই অস্থিতিশীল করছে না চীনের আর্থিক সহায়তায় পাকিস্তানে নির্মাণাধিন চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর (সিপিইসি)-কেও বানচাল করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি বালুচিস্তানে হামলা চালিয়ে পাকিস্তান নিরাপত্তা বাহিনীর ১৪ সদস্যকে হত্যা করে বিএলএ। এই হামলার জন্য ইরানকে দোষারুপ করে পাকিস্তান। ইরানে বিএলএ’র নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে বলে পাকিস্তান মনে করে। ওই হামলার পর পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতর ইরানের সামলোচনা করে বিচ্ছিন্নতাবাদি গ্রুপটির বিরুদ্ধে দমন অভিযান না চালানোর জন্য। এতে বুঝা যায় বালুচিস্তানের আন্ত:সীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ইসলামাবাদ।
সম্প্রতি গোয়াদারে এই গ্রুপটির আরেক হামলা পাকিস্তানের জন্য অনেকগুলো শিক্ষা রেখে যায়। প্রথমত এই জঙ্গি গ্রুপটি উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা কাঠামো ভেদ করতে সক্ষম। এতে গ্রুপটির ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, গোয়াদার হামলা প্রমাণ করে চীনের নেতৃত্বে বালুচিস্তানের অর্থনৈতিক প্রকল্পটিকে খাটো করতে সম্মিলিত অপচেষ্টার অংশ বিএলএ’র এই হামলা। তাই পাকিস্তানের এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন ছিলো যা বালুচিস্তানের সীমানাকে ছাড়িয়ে যায়।
মজার বিষয় হলো গোয়াদার হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের কয়েকজন ছিলো নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকায়। এই জঙ্গি গ্রুপটির উজ্জীবিত হওয়া প্রমাণ করে বিএলএ এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো শুধু আঞ্চলিকভাবে নিরাপদ আশ্রয়ই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি সেই সাথে তারা অন্য জঙ্গিগ্রুপগুলোর সঙ্গেও সহযোগিতা করে থাকতে পারে। আফগানিস্তানে এ ধরনের সংগঠন হতে পারে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাকিস্তান সম্প্রতি সন্ত্রাসদমন অভিযান চালানোর পর টিটিপি আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে টিটিপি ও বিএলএ’র মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়টি পাকিস্তান উপেক্ষা করতে পারে না।
ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সমঝোতার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান যে বিএলএ-কে সন্ত্রাসী গ্রুপের তালিকায় ফেলতে চাইবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আফগান তালেবান ও অনান্য অংশীজনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শান্তি চুক্তিতে ওই অঞ্চলে বালুচ জঙ্গিদের আস্তানা ও সমর্থন ভিত্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। র‌্যান্ড কর্পোরেশন আফগানিস্তানের ব্যাপারে একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে, যেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনে বালুচ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সমঝোতার কথা উল্লেখ রয়েছে।
বিএলএ-কে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় ফেলা নি:সন্দেহে পাকিস্তানের কূটনীতির জন্য একটি বিজয়। এতে ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়। এই অগ্রগতি নিশ্চিতভাবে আস্থার ঘাটতি কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

No comments

Powered by Blogger.