নেপালে চীনের পদচিহ্ন বাড়ছে

চীন শুধু নেপালের গভীরেই প্রবেশ করেনি, হিমালয় অঞ্চলের এই দেশটির অবকাঠামো খাতে বড় বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি কাঠমান্ডুর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সিস্টেমেও জড়িয়েছে তারা এবং বেইজিংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়মিত নেপাল সফর করছেন। এখানকার বিশেষজ্ঞদের মত এটা। ‘অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব নেপাল চায়না রিলেশান্স’ শীর্ষক এক আলোচনায় নেপালে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রঞ্জিত রায় বলেছেন, চীন নেপালে তাদের পদচিহ্ন বাড়ালেও “সেটা এত বড় নয় যে, এতে ভারত-নেপাল সম্পর্কের ক্ষতি করবে”।

প্রফেসর এস ডি মুনির মতে, চীন নেপালের দিকে এগিয়ে আসার একটা কারণ হলো তিব্বত নিয়ে তাদের স্পর্শকাতরতা এবং একই সাথে দালাই লামার বিষয়ে কাঠমাণ্ডুর আতঙ্ক। নেপালের বিরুদ্ধে পাঁচ মাসব্যাপী যে সীমান্ত অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে সময় নেপালে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন রায়। তিনি বলেন যে, নেপালে চীনের অংশগ্রহণের বিষয়টি অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

রায় বর্তমানে কমনওয়েলথ হাই লেভেল গ্রুপ অব গভর্নেন্সের সদস্য। আলোচনায় তিনি বলেন, “নেপালের একক বৃহত্তম এফডিআইয়ের উৎস হলো চীন। এবং সেখানে কোন ছোটখাটো প্রকল্পে তারা যুক্ত হয়নি, বরং বড় প্রকল্পগুলো – যেমন সিমেন্ট, বিমানবন্দর, সড়ক, পরিবহন লাইন, রেলওয়ে, অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের মতো বড় প্রকল্পগুলোতে চীন কাজ করছে। নেপালে চীনের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ব্যাপক”।

নেপালে চীনা ব্যাংকগুলোও কাজ শুরু করেছে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অনুপাত ৪৫:১, যেটা বেইজিংয়ের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে আছে।

তিনি আরও বলেন, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগও দ্রুতগতিতে বাড়ছে, প্রচুর চীনা পর্যটক নেপালে আসছে, বিশেষ করে পোখারায়। দুই দেশের মধ্যে ১৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং এই সীমান্ত দিয়ে সংযোগের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নেপাল-চায়না ট্রান্স-হিমালয়ান মাল্টি-ডায়মেনশনাল কানেকটিভিটি নেটওয়ার্ক (টিএইচএমসিএন) চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটা অংশ। প্রস্তাবিত এই ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলওয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ তিব্বতের কেরুংয়ের সাথে কাঠমাণ্ডুর এবং এরপর নেপাল-ভারত সীমান্তের লুম্বিনি পর্যন্ত সেটা সম্প্রসারিত হবে।

নেপাল ও চীন এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়াতেও অংশ নিয়েছে, এবং বেইজিং নেপালকে অস্ত্র ও সরঞ্জামও সরবরাহ করছে। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নেপাল সফর করেছে এবং দুই পক্ষের মধ্যে নিয়মিত বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু নেপালে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সফর হয়েছে বহুদিন আগে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নেপালে চীনের শক্ত অবস্থান রয়েছে এবং মাধেসি দলগুলোর সাথে তাদের যথেষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। দুই কমিউনিস্ট দলের একীভূত হওয়ার পেছনেও “চীনের প্রবল পৃষ্ঠপোষকতা ছিল”।

জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এমেরিটাস এবং লাওসে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মুনির মতে, নেপালে চীনের অংশগ্রহণের বিষয়টি তাদের বৈশ্বিক ও এশিয়া কৌশলের একটা অংশ। নেপালের অর্থনীতিতে চীনের অংশগ্রহণের ব্যাপারে মুনি বলেন, চীনা কোম্পানিগুলো তাদের ‘সম্পৃক্তি মাত্রায়’ চলে যাওয়ায় কারণে এবং বেইজিং তাদেরকে ব্যস্ত রাখতে চায় বলেই চীন নেপালের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

মুনি বলেন, “চীনা প্রবৃদ্ধি কমতে থাকায় এবং তাদের কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক চাহিদার কারণে এবং নতুন চাহিদা ও নতুন বাজার দখলের জন্য, চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নজর দিয়েছে”। দক্ষিণ এশিয়া ১.৬ বিলিয়ন জনসংখ্যার একটা অঞ্চল যেখানে প্রবৃদ্ধির হার ৫-৭ শতাংশ। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে এটা একটা ‘বিশাল বাজার’।

মুনি বলেন, ‘মালাক্কা সমস্যা’ নিয়েও চীন উদ্বিগ্ন। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য চীন পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সাথে, শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা এবং মিয়ানমারের সিত্তয়ে বন্দরের সাথে যুক্ত হয়েছে”।

তিনি বলেন, “চীন চায় না যে দক্ষিণ এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের  বিরুদ্ধে জোট বাঁধুক। নেপালে বেইজিংয়ের অন্তর্ভুক্তির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভারতকে জায়গামতো ধরে রাখা”।

No comments

Powered by Blogger.