পরিবারের সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত by পিয়াস সরকার

রাজধানীর শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। জরুরি বিভাগের পেছনেই মসজিদ। আর দেয়ালের বিপরীতে ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনের সামনে দুটি চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছেন ৩ জন রোগী। তারা প্রত্যেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত। আবার ৩ জনই একই পরিবারের সদস্য। বাবা-মা-ছোট ভাইয়ের পাশে বসা বড় মেয়ে। পাশে বসা তার ছোট খালা।
আর রক্ত পরীক্ষা, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি আনা নেয়ায় ব্যস্ত তার স্বামী।

পুরো হাসপাতাল জুড়ে ছড়াছড়ি ডেঙ্গু রোগীদের। ঠাঁই নেই বেড, কেবিন এমনকি বারান্দাতেও। আশরাফুল হক। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বয়স তার ৪৮। থাকেন মোহাম্মদপুরের লোহারগেইট এলাকায়। তিনি পেশায় লন্ড্রি দোকানদার। এছাড়া সেই দোকানে বিক্রি করেন বালিশ, কোলবালিশ, জাজিম ইত্যাদি। তার স্ত্রীর নাম রোকসানা বেগম। তার প্রেসক্রিপশনে লেখা বয়স ৪০। দোকানটি ঘিরেই তাদের সংসার। স্বপ্ন। এই দম্পতীর দুই সন্তান। বড় মেয়ের নাম ইয়াসমিন আরা। বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগে। আর নবম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে। প্রেসক্রিপশনে লেখা নাম মো. রবিন। বয়স ১৩। এই সাজানো গোছানো ছোট পরিবারটি ডেঙ্গুর ছোবলে জর্জরিত।
গতকাল বুধবার দুপুর দুটার দিকে দেখা যায় তাদের মায়ের চলছে স্যালাইন। বাবার হাতেও লাগানো ক্যানোলা। আর ছোট ভাই ঘুমে কাতর। পাশে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন মেয়ে।

ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বুধবার লন্ড্রীতে ছিলেন তাদের বাবা আশরাফুল। শরীর খারাপ হলে ৮ টার দিকে লন্ড্রি থেকে বাড়িতে চলে আসেন। সাধারণত তিনি বাড়ি ফেরেন রাত ১১টার দিকে। তাদের দোকানে কাজ করেন ফুপাতো ভাই রাসেল। রাতেই হালকা জ্বর অনুভুত হয়। পরদিন তিনি আর লন্ড্রিতে যাননি। সেদিন প্রতিবেশীর পরামর্শে শিয়া মসজিদ এলাকায় করান রক্ত পরীক্ষা। তবে কোন ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়েনি সেদিন। এরপর সেদিন রাতে ছোট ভাইয়ের দেখা দেয় জ্বর। আর দেরি করেন না তারা। বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে চলে আসেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে। শুক্রবার সকালে পরীক্ষা করান। দুজনরই ধরা পড়ে ডেঙ্গু।
সেদিন থেকে চলতে থাকে চিকিৎসা। শরীর দুর্বল লাগায় শনিবার রাতে মেয়েকে হাসপাতলে রেখে বাড়িতে চলে আসেন মা। বাবা ও ভাইয়ের পাশেই ছিলেন তিনি। কিন্তু রাতে জ্বর দেখা দেয় মায়ের। লন্ড্রির দায়িত্বে থাকা ফুপাতো ভাই সকালেই নিয়ে আসেন হাসপাতালে। রক্ত পরীক্ষার পর জানতে পারেন- ডেঙ্গু।

ভীষণ অনিশ্চয়তায়, ঘুমহীন দিন কাটছে পরিবারটির। প্রত্যেকের শরীর দুর্বল। কথা হয় ইয়াসমিনের স্বামী লোকমানের সঙ্গে। তিনি পেশায় সিএনজি চালক। এছাড়া তার রয়েছে ৩টি সিএনজি ও ১০টির মতো রিকশা। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৬/৭ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। প্রতিদিনই ৩ জনের রক্ত পরীক্ষা করাই। এখানে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাইরে থেকে করে আনি। এই রিপোর্ট আনা নেয়াতে চলে যায় দিনের ৫/৬ ঘণ্টা।

তিনি জানান, প্রতিটি পদক্ষেপে বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। বড় বিপত্তি প্রসাব পায়খানা। শাশুড়িকে সঙ্গে করে নিয়ে যান খালা ও তার স্ত্রী। আর শ্যালককের সঙ্গে থাকেন তিনি। এতে খুব একটা ধকল না হলেও শ্বশুরের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে একজনকে। বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। এতে ভীষণ বিব্রত তিনি। তবে পাশে না থেকে উপায় নেই বলেও জানান তিনি।

তিনি আরো জানান, প্রত্যেকের রক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে প্রতিদিন। তবে তার শ্বশুরের অবস্থা কিছুটা খারাপ। তার রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা উঠা-নামা করছে। আর শ্বাশুড়ির জ্বরটাও কমছে না। সেখানে দায়িত্বরত নার্স জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, দুজনেরই ডায়াবেটিক থাকার কারণে একটু ধীর গতিতে উন্নতি হচ্ছে। আর তাদের ছেলের অবস্থা উন্নতির দিকে।

কথা হয় মেয়ে ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুক্রবার থেকে এখানে আছি। ভয়ে আছি। আব্বা ঘুামাতে পারছেন না। রাতে ঘুমালে কেঁপে কেঁপে উঠছেন। বুকে কফ জমে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আম্মা সারাদিন কান্নাকাটি করে। ছোট ভাইটা কিছুই খেতে চায় না। আমার স্বামী শুক্রবার থেকে এখানে।

ফুপাতো ভাই ও লন্ড্রির দোকানে কর্মরত রাসেল বলেন, আমরা থাকি লোহার গেটের পাশে। আর এখানেই একটি ক্যানেল রয়েছে। এটি এতো ময়লা আর দুর্গন্ধযুক্ত। এতে জমে আছে পানি। এটা একটা মশা তৈরির কারখানা। এখানে সারাবছর আটকে থাকে পানি। কিছুদিন আগে খনন করা হলেও এখন আবার সেই পূর্বের অবস্থা বিরাজ করছে।

দায়িত্বরত চিকিৎসক তাসলিমা বলেন, ছোট ছেলেটির অবস্থা ভালো। তাকে হয়তো আজই ছেড়ে দেয়া হবে। আর মায়ের অবস্থাও শঙ্কামুক্ত। তবে ডায়াবেটিক থাকায় কিছুটা পর্যবেক্ষণে রাখতে হচ্ছে। আর তার বাবার অবস্থা কিছুটা বিপদজনক। তার রক্তের প্লাটিলেট উঠা নামা করছে।

No comments

Powered by Blogger.