ভারতে বিদ্বেষের স্রোতে ডুবছে সংখ্যালঘুরা by কৃতি সিং

ভারত সরকার যখন গোরক্ষা কমিটির প্রহারে মৃত্যু নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের ক্রুদ্ধ জবাব দিয়েছে, তখনই আরেক তরুণ মুসলিমকে পিটিয়ে মারা হয়।
তাবরেজ আনসারি নামের ২৪ বছর বয়স্ক ওই তরুণকে পেটানোর ভিডিও প্রচারের পর দেশব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ওয়েল্ডার হিসেবে অন্য এক রাজ্যে কর্মরত আনসারি ঈদ উদযাপনের জন্য তার রাজ্য ঝাড়খন্ডে গিয়েছিল। গত ১৭ জুন তাকে মোটরসাইকে চুরির চেষ্টার অভিযোগে আটক করা হয়। তাকে একটি থামের সাথে বেঁধে প্রায় ১৮ ঘণ্টা প্রহার করা হয়, হিন্দু দেবতার প্রশংসাসূচক ‘জয় শ্রী রাম’ ও ‘জয় হনুমান’ বলতে বাধ্য করা হয়।
তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, চার দিন পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানে সে মারা যায়।
নোবেল পুরস্কারজয়ী ভি এস নয়পাল যে দেশকে লাখ লাখ বিদ্রোহের দেশ বলে অভিহিত করেছিলেন, সেই ভারত এখন একের পর পিটিয়ে মারা ও জখম করার ঘটনা দেখছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর দেশব্যাপী প্রায় ২৬৫টি ঘটনার কথা জানা গেছে। এগুলোর প্রায় ৫৯ ভাগ ক্ষেত্রে শিকার হচ্ছে মুসলিমেরা। আর ৫৮ ভাগ হামলাকারী হচ্ছে হিন্দু।
গত ৫ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর বিদ্বেষপ্রসূত হামলা ১০ গুণ বাড়ার চিত্র পাওয়া যায় এতে। সমালোচকদের মতে, মোদির হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই বৃদ্ধি।
ঝাড়খন্ডে ২০১৬ সাল থেকে বিদ্বেষপ্রসূত হামলার ১৪তম শিকার হলেন আনসারি। এ তথ্য পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইট ফ্যাক্টচেকার.ইনের। সাবেক সাংবাদিক সকেট গোখলে বলেন, প্রহারের ঘটনার সাথে প্রধানমন্ত্রীর নিজের দলের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পুলিশের নিস্কৃয়তায় প্রহারের ঘটনায় সরকারি সমর্থনের প্রমাণ স্পষ্ট হয়।
গোরক্ষা কমিটি
প্রাচীন বর্ণবাদী ব্যবস্থা অনুসরণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে যারা নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্যাতিত হয়েছে। দলিত নামে পরিচিত এসব শ্রেণির লোক মুসলিম সংখ্যালঘুদের মতো ক্রমবর্ধমান বিদ্বেসপ্রসূত হামলার টার্গেট হচ্ছে। ভারতে মুসলিমরা হচ্ছে সংখ্যায় ২০ কোটি, মোট জনসংখ্যার ১৪ ভাগ। তাদের ওপর হামলার ধরনটি যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী হামলার সমতুল্য।
পিটিয়ে হত্যার ঘটনা প্রবলভাবে সামনে আসে ২০১৫ সালে মোহাম্মদ আখলাকের ঘটনায়। ৫০-এর কোঠায় বয়স্ক এই লোকটিকে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে তার গ্রামে দাঙ্গাবাজেরা হত্যা করে। তার বাড়িতে জবাই করা বাছুরের গোশত আছে, এই সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
পরে সরকারি তদন্তে দেখা যায়, তার বাড়িতে গরুর গোশত ছিল না। ওই হামলার এক আসামি মারা যায় ২০১৬ সালে। তখন গ্রামের অধিবাসীরা তার লাশ জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়।
এরপর থেকে গো রক্ষাকারীদের তাণ্ডব আরো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। ২০১৭ সালে ঝাড়খন্ডে ব্যস্ত বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে ৩০ জনের একটি গোরক্ষা দল আলিমুদ্দিন আনসারিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।
তিনি গরুর গোশত পরিবহন করছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
গত বছর বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশে মোহাম্মদ কাসিম নামের ৩৮ বছর বয়স্ক এক লোককে হত্যা করা হয় গরু চুরির অপবাদে।
জুলাইতে গরু পাচারের অভিযোগে রাজস্থানে রাকবার খান নামের একজনকে হত্যা করা হয়।
মোদির সমালোচনায় যুক্তরাষ্ট্র
আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন ২১ মে প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও। এতে বলা হয়, মুসলিম ও নিম্নবর্ণের দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চলছে, তাদেকে ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি করা হচ্ছে।
এদিকে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে পম্পেও ২৫ জুন ভারত সফর করেন। তবে প্রতিবেদনটির সাথে পম্পেওর ভারত সফরের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সরকারের পরিসংখ্যানে গত দুই বছরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ব্যাপকভাবে বাড়ার ইঙ্গিত দিলেও মোদি প্রশাসন সমস্যাটির সমাধান করেনি।
প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো পরীক্ষা করা হয়। এতে প্রধানত মুসলিমদের ওপর হামলার জন্য মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কথা বলা হয়।
তবে মোদি সরকার এর জবাবে জানিয়েছে, ভারত তার সেক্যুলার পরিচিতি, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ও বহুত্ববাদী সমাজ নিয়ে গর্বিত।
পিটিয়ে মারার ঘটনা নিয়ে মোদি নীবর রয়েছে। তবে সাধারণ নির্বাচনের পর পার্লামেন্টে উদ্বোধনী ভাষণে তিনি এর নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ঝাড়খন্ডে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনক। তবে এজন্য কেন পুরো রাজ্যকে দোষী করা হবে। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার সহিংসতাকে একইভাবে বিবেচনা করা হবে।
ভারতীয় বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট উমার খালিদ বলেন, বিজেপিই সমাজে মেরুকরণ করছে।
তিনি বলেন, এল কে আদভানির নেতৃত্বে দাঙ্গা সৃষ্টিকারী সমাবেশের মাধ্যমে এই মেরুকরণ করা হয়েছে। এখন মোদির আমলে হামলার নিত্যদিনের ঘটনাগুলো ঘটছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাবদিহিতায় আনার মতো শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবকে এজন্য দায়ী।
এই অবস্থা দূর করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন গোখলে। তিনি ঝাড়খন্ড পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সংখ্যালঘুবিষয়ক জাতিসংঘ বিশেষ র‌্যাপোটিয়ার ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ হাই কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেন, ভারতে সংখ্যলঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যেসব অপরাধ হচ্ছে, সেগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন। জেনেভা কনভেনশনে সইকারী হিসেবে এবং জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে ভারত সরকার প্রান্তিকদের রক্ষা করার প্রতি তার প্রতিশ্রুতিগুলোর সম্মান প্রদর্শনে বাধ্য। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, আমাদেরকে এখন আন্তর্জাতিক সমর্থন কামনা করতে হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.