সামাজিক বয়কট অবজ্ঞা করে মুসলিম পরিবারকে আশ্রয় দিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ পুরোহিত by সুবীর ভৌমিক

আমরা এখানে যার কথা বলছি, তিনি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে ক্যারিশমেটিক নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু নন। এই সুভাষ এক গরিব বাঙারি ব্রাহ্মণ। তিনি স্বামী পরিত্যক্তা এক মুসলিম নারী ও তার দুই সন্তানকে আশ্রয় প্রদান করার জন্য তার জীবিকা হারিয়েছেন।

সাকিনা বিবি ও তার সন্তানদের তাড়িয়ে না দিয়ে সুভাষ রায়চৌধুরী এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ভারতে যেখানে বিশেষ করে ২০১৯ সালের এপ্রিল-মে মাসের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরার পর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধ তীব্রভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

পেশায় হিন্দু পুরোহিত সুভাষের আয় আসে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় তার পৈত্রিক গ্রাম চোওয়ায় হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে।

চলতি বছরের প্রথম দিকে তার মেয়ে কাকলী (তিনি তালাকপ্রাপ্তা) সুভাষকে অনুরোধ করেন সাকিনা বিবি ও তার সন্তানদের আশ্রয় দিতে। স্বামীর তাড়িয়ে দেয়া সাকিনা ও তার সন্তানেরা তখন আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সুভাষ ও তার স্ত্রী ইলা তৎক্ষণাতই তাতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু সাথে সাথেই অন্যান্য গ্রামবাসী ঝামেলা সৃষ্টি করেন।

সাউথ এশিয়ান মনিটরকে সুভাষ রায়চৌধুরী বলেন, তারা আমাকে বলল, ঠাকুরমশাই, আমাদের পূজায় আর আপনাকে ডাকব না। আমি জানতাম যে এক মুসলিম নারী ও তার সন্তানদের আশ্রয় দেয়ায় তারা কষ্ট পেয়েছে। এই সময়ে ধর্ম অনেক আবেগ উস্কে দেয়। কিন্তু আমার কাছে গৃহহীন, অরক্ষিত এক নারীই আসল ধর্ম। সে মুসলিম না হিন্দু তা আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।

তিনি বলেন, তার স্ত্রী ও মেয়েও সাকিনা বিবি ও তার সন্তানদের তাদের বাড়িতে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ইলা বলেন, তারা এখন আমার পরিবারের সদস্য। আমরা যা পারি তা ভাগাভাগি করে নেই। অবশ্য গ্রামবাসীরা পূজা করতে না চাওয়ায় আমার স্বামী কঠিন অবস্থায় পড়ে গেছে।

সাকিনার প্রতি সুভাষ ও ইলা প্রবল অনুরাগ থাকার কারণ তাদের মেয়ে কাকলীও বিয়ে ভাঙার পর একই ধরনের দুর্ভোগে পড়েছিল।

সুভাষ বলেন, বিয়ে ভাঙার পর একটা মেয়ে কত দুর্ভোগে পড়ে, তা আমরা জানি। এ কারণে সাকিনা যত দিন কোনো আশ্রয় ও জীবিকা না পাবে, তত দিন আমরা তাকে আশ্রয় দেব।

সাকিনা বলেন, রায়চৌধুরীরা তার ধর্মকর্ম পালনে কোনো বাধা দিচ্ছেন না।

তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাসে আমি রোজা রেখেছি। তারা এমনকি তাদের সামান্য আয় থেকেই আমার জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এখন পর্যন্ত সাহায্য নিয়ে কোনো রাজনীতিবিদ রায়চৌধুরীর কাছে যায়নি। কেবল হরিহর্পার (গ্রামটি এর আওতায়) ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার পূর্ণেন্দু সান্যাল সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন।

সান্যাল বলেন, যে কাজ করেছে তারা তার জন্য আমি সব গ্রামবাসীকে সুভাষ ও তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে বলেছি। তাদেরকে সুভাষ যাতে পূজা করা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে সুযোগ দিতেও তাদের বলেছি। পরিবারটি বিরলভাবে ঈশ্বরের সেবা করছে।

স্থানীয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত রায়চৌধুরীদের ২৫ কেজি চাল ও অন্যান্য সামগ্রী এবং স্থানীয় একটি কলেজ দিয়েছে ৫ হাজার রুপি।

কোনো কোনো নেতা এই ঘটনার উল্লেখ করে বলছেন যে বাঙালি সমাজে সেক্যুলার ও উদার মূল্যবোধ যে কতটা গভীর, এটিই তার প্রমাণ।

বাংলা পক্ষের নেতা গর্গা চ্যাটার্জি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গেরুয়া আক্রমণ শানালেও বাংলা এখনো সামাজিক আধুনিকতার দিকে থেকে বাকি ভারত থেকে এগিয়ে রয়েছে।

বাঙ্গালী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘনঘন প্রাথমিক ব্রিটিশ শাসনের সময় সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে জনপ্রিয় সিরিয়াল প্রচার করছে।

বিশ্লেষক সুখোরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেন, সিরিয়ালে যখন রাজা রামমোহন বা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে রক্ষণশীল পুরোহিতদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখা যায়, তখন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বাংলার মহান ঐতিহ্যের সংগ্রামের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

তিনি এসএএমকে বলেন, এই লড়াইটি আবার এখন লড়তে হবে।

পায়েল রোহত্যাগির মতো গেরুয়া বা হিন্দুত্ববাদী সমর্থকেরা রাজা রামমোহনকে ব্রিটিশদের চামচা বলে গালি দিয়েছিলেন। এতে পশ্চিমবঙ্গে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।

কলকাতায় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের রোডশোয়ের সময় বিজেপি কর্মীদের কথিত বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে ফেলার ঘটনা ঘটলে লোকসভার নির্বাচনের শেষ ধাপের ৯টি নগর আসনের সব কটিতেই বিজেপি হেরে যায়।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম এমপি নুসরাত জাহান হিন্দু ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রায় অংশ নিলে গেরুয়া সমর্থকেরা একদিকে যেমন স্বাগত জানিয়েছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক খেলা হিসেবেও অভিহিত করেছে। এক হিন্দু ব্যবসায়ীকে বিয়ে করা নুসরাত জানিয়েছেন, তিনি শৈশব থেকেই তার বাবার সাথে রথযাত্রায় যেতেন, মেলা থেকে খেলনা কিনতেন, মিষ্টি কিনতেন।

পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, নুসরাতের রথযাত্রা যদি সেক্যুলার ঘটনা হয়ে থাকে, তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা কেন হয় ইফতার পার্টিতে যাওয়ার জন্য?

তিনি বলেন, আসল কথা হলো, বাংলার সংস্কৃতি হলো আন্তঃধর্মীয় ও সমন্বয়বাদী। বাকি দেশ যদি তা বুঝতে না পারে, তবে তা আমাদের সমস্যা নয়।

তিনি বলেন, বাংলার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা উদযাপনে গঠিত অনেক কমিটির প্রধান থাকেন মুসলিম সামাজিক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার ঈদ অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকেন অনেক হিন্দু।

বিজেপি-আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ আনছে তীব্রভাবে। কিন্তু তিনি জোরালোভাবে তার কার্যক্রমকে সমর্থন করে যাচ্ছেন এই বলে যে তিনি বাংলার সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি বজায় রাখছেন।

No comments

Powered by Blogger.