ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ৯ খাতে বাণিজ্য জড়িত যারা by জাবেদ রহিম বিজন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে রয়েছেন জেল সুপার, জেলার ও ডেপুটি জেলারসহ আরো কয়েকজন। তাদের সহযোগী ২৭ কারারক্ষী। এর মধ্যে ২৬ জনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। আরেকজনকে করা হয়েছে বরখাস্ত। তবে বহাল রয়েছেন জেল সুপার, জেলার ও ডেপুটি জেলারসহ অন্য কর্মকর্তারা। সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শেষে দায়ী কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে এই কারাগারে বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য, চিকিৎসা বাণিজ্য, পিসি বাণিজ্য, পদায়ন বাণিজ্য, কারা অভ্যন্তরে নিষিদ্ধ মালামাল প্রবেশ এবং জামিন বাণিজ্যসহ সকল অপকর্মের সঙ্গে জেল সুপার নূরন্নবী ভূঁইয়া, জেলার এজি মাহমুদ, ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির, হিসাবরক্ষক মো. নাজিম উদ্দিন সরাসরি জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। ২৮শে এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর মে মাসেই ওই ২৬ কারারক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
তার আগে বরখাস্ত করা হয় সর্বপ্রধান কারারক্ষীকে। কিন্তু কর্মকর্তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জেল সুপার নূরন্নবী ভূইয়া ৪ বছর ধরে এই কারাগারে রয়েছেন। ২০১৫ সালের ১৮ই মে এখানে যোগদান করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার নিয়ে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো সবই সত্য উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় ধারাবাহিকভাবে এসকল অনিয়ম ডেপুটি জেলার, জেলার এবং জেল সুপারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের নাম উল্লেখ করা হয়। দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মাঝে নিম্নমানের দুধ সরবরাহ এবং অন্য কোনো খাবার শিশুদের মাঝে সরবরাহ না করার অমানবিক ও নির্মম আচরণ প্রদর্শনসহ দায়িত্বে অবহেলার সঙ্গে সর্বপ্রধান কারারক্ষী মো. আব্দুল ওয়াহেদ সরাসরি জড়িত বলে উল্লেখ করা হয় এতে। একাজে হাসপাতালের ডিপ্লোমা নার্স মো. নাজিরুল ইসলামও জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এছাড়া নিম্নমানের খাবার সরবরাহের সঙ্গে ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির, জেলার এজি মাহমুদ এবং জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়া সরাসরি জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কারা হাসপাতালের চিকিৎসা সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে কারারক্ষী শরিফ উদ্দিন, সহকারী সার্জন মো. হুমায়ুন কবির রেজা ও ডিপ্লোমা নার্স মো. নাজিরুল ইসলাম সরাসরি জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। জেলা কারাগারের ক্যান্টিনের বিপরীতে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের সঙ্গে কারারক্ষী রনি দে, হাবিবুর রহমান, আল আমিন এবং হিসাবরক্ষক মো. নাজিম উদ্দিন, ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির, জেলার এজি মাহমুদ এবং জেল সুপার নূরন্নবী ভূঁইয়া সরাসরি জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া কারাগারে বন্দি বেচাকেনা ও সিট বাণিজ্যের অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে সর্বপ্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ, সহকারী প্রধান কাররক্ষী মো. নাছির উদ্দিন, মো. মন্তাজ মিয়া, মো. সেলিম মিয়া, বাদল মিয়া, কারারক্ষী মফিজুর রহমান, নাজমুল হোসেন (নং ২২৮৫৬), নাজমুল হোসেন (নং২২৫৯৭), আল আমিন, হাবিবুর রহমান ও ফজলুল হক, সাক্ষাৎ বাণিজ্যের সঙ্গে সর্বপ্রধান কাররক্ষী আবদুল ওয়াহেদ, প্রধান কারারক্ষী নজরুল ইসলাম, এনায়েত উল্লাহ, সুব্রত মৎসুদ্দী, ইকবাল হোসেন, গেট অর্ডার সহকারী প্রধান কারারক্ষী হুমায়ুন কবির, কারারক্ষী জহিরুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান, কারা অভ্যন্তরে মাদকসহ নিষিদ্ধ মালামাল প্রবেশ ও ব্যবহার সংক্রান্ত অনিয়ম দুর্নীতিতে সর্ব প্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ, সিআইডি সহকারী প্রধান কারারক্ষী মো. নাছির উদ্দিন, সহকারী প্রধান কারারক্ষী মো. মন্তাজ মিয়া, মো. সেলিম মিয়া, বাদল মিয়া, সিআইডি কারারক্ষী মফিজুর রহমান, কারারক্ষী নাজমুল হোসেন, আল আমিন, নাজমুল হোসেন, হাবিবুর রহমান, ফজলুল হক, জহিরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, গেট অর্ডার সহকারী প্রধান কারারক্ষী হুমায়ুন কবির, প্রধান কারারক্ষী নজরুল ইসলাম, এনায়েত উল্লাহ, জামিন বানিজ্যের সাথে কারারক্ষী হেলাল উদ্দিন, পিসি বাণিজ্যের সাথে সর্বপ্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ, প্রধান কারারক্ষী নজরুল ইসলাম, এনায়েত উল্লাহ, সুব্রত মৎসুদ্দী, ইকবাল হোসেন, কারারক্ষী নূর মোহাম্মদ, মো. ইমাম হোসেন, রিয়াদ মাহমুদ, হেলাল উদ্দিন ও রাসেল খান জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির, জেলার এজি মাহমুদ এবং জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়ার সরাসরি জড়িত থাকার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে কারারক্ষীদের নিকট থেকে হিসাবরক্ষকের মাধ্যমে জেলার এবং জেল সুপার অর্থ আদায় করে থাকেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়া বলেন-বেনামী অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত হয়েছে। একটা অভিযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগকারী থাকতে হবে, সাক্ষী লাগবে, ঘটনার স্থান থাকতে হবে। হাওয়ার ওপরে বলে দিলাম অমুকে এই কাজ করেছে তাহলেতো হলো না। আমরা এর জবাব দেব। জেল সুপার এজি মাহমুদ বলেন- কারাগার নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার কারণেই তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তিনি সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। এই কমিটি গত ৬ই এপ্রিল ৫১ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। যাতে কারাগারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগঠিত অনিয়ম-দূর্নীতির বিস্তারিত বিবরন তুলে ধরা হয়। এই প্রতিবেদন দাখিলের পরই মে মাসে কারা মহা পরিদর্শক ২৬ কারারক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন।
যে ২৬ কারারক্ষী বদলি: প্রধান কারারক্ষী সুব্রত মৎসুদ্দী (নং২১৫৪৬), ইকবাল হোসেন (নং২১১৩৬), নজরুল ইসলাম (০২৫৬৩), এনায়েত উল্লা্যাহ (০২৫৬৫), সহকারী প্রধান কাররক্ষী মো: মন্তাজ মিয়া(২১২৬০), মো: সেলিম মিয়া (২১২৬৮), বাদল মিয়া (২১৬১১), হুমায়ুন কবির (২১৬৪৯), মো: নাছির উদ্দিন (২১২৫২), কারারক্ষী হেলাল উদ্দিন (২২২৬৬), রাসেল খান (২২৮৬৯), নূর মোহাম্মদ (২২২৪৭), মো: ইমাম হোসেন (২২৩৪৪), রিয়াদ মাহমুদ (২২০৭৩), জহিরুল ইসলাম (২২০৪৭), হাবিবুর রহমান (২২২৬৮), আবুল হাসান (২২৪৩৭), মাইন উদ্দিন মজুমদার (২১৮২৭), রনি দে (২২৮২৭), হাবিবুর রহমান (২২২৭৩), আল আমিন (২২৮৭২), মফিজুর রহমান (২২৬১৩), নাজমুল হোসেন (২২৮৫৬), নাজমুল হোসেন (২২৫৯৭), ফজলুল হক (২২১৩৭), মো: শরীফ উদ্দিন (২২৪৭০)। এর আগে সর্ব প্রধান কাররক্ষী আবদুল ওয়াহেদকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.