মোদির গো–গোঁয়ার্তুমিতে দিশেহারা কৃষক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, গোরক্ষা হচ্ছে তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ। ব্যস, বন্ধ করে দিলেন গোহত্যা। এতে গোকুল ফুলফেঁপে অনেক হয়ে গেল। আর কৃষকের খেতখামারে গিয়ে হামলে পড়তে লাগল। চাষবাস শিকেয় ওঠার জোগাড় কৃষকদের।
যে ফসল কৃষকের সারা বছরের অন্ন জোগাবে, সে ফসলই যে সাবাড় করে দিচ্ছে গরু। দুই কূল রক্ষা করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে রঘুবীর সিং মিনারের মতো কৃষকদের।
এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কৃষকের বিপুল সমর্থন পেয়েছিল মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তবে ক্ষমতায় এসে দলটির গরু রক্ষায় কড়াকড়ি আরোপ গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরু হিন্দুধর্মের জন্য পবিত্র বিষয়। তাই হিন্দু কৃষকেরা পড়েছেন উভয়সংকটে। গত ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফা নির্বাচন শুরু হওয়ার প্রাক্কালে নিজের মটরখেতের দিকে তাকিয়ে সেই কথাই জানালেন পশ্চিম ভারতের রাজস্থান রাজ্যের পিলানি জেলার হিন্দু কৃষক রঘুবীর সিং মিনা। তিনি বলেন, ‘সব চেষ্টাই করেছি। কাকতাড়ুয়া বসিয়েছি, কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছি। কিন্তু যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো গরুগুলো আমাদের ফসল খাওয়ার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না।’
বিজেপি সরকারকে ইঙ্গিত করে রঘুবীর সিং বলেন, ‘তারা তাদের রাজনীতির খেলা খেলছে। তারা গরিব কৃষকদের কথা ভাবে না।’ এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদে লড়ছেন নরেন্দ্র মোদি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসার আগেও গরু জবাই ও মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল রাজস্থানসহ আরও অনেক রাজ্যে। যদিও কাগজে-কলমে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার বিপুলসংখ্যক মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। অথচ গরু রক্ষায় আইন আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে এবং আইন লঙ্ঘনে সাজাও বাড়ানো হয়েছে। ২০১৭ সালে বিজেপি সরকার দেশটি জুড়ে মাংসের জন্য গরুর ব্যবসা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। তবে এই একটি বিষয়ই আটকে দেন সুপ্রিম কোর্ট।
সমালোচকদের ভাষ্য, বিজেপি ‘হিন্দুত্ববাদ’ আরোপের মিশন নিয়ে নেমেছে। ১২৫ কোটি জনসংখ্যার শক্তিশালী দেশ ভারতে প্রভুত্ব থাকবে হিন্দুদের। সমালোচকেরা সতর্ক করেছেন এই বলে যে গরুকে কেন্দ্র করে বিজেপি গ্রামের প্রান্তিক হিন্দু মাতবরদেরও সংখ্যালঘু মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালাতে দুঃসাহসী করে তুলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালের মে মাস থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গরুকে কেন্দ্র করে ভারতে ৪৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন রাজস্থানের।
বিজেপি বলেছে, তারা এ ধরনের সহিংসতার বিরোধী। কিন্তু হামলার ভয় ও কঠোর আইন গরু–বাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ কারণে কৃষকেরা মাংসের জন্য বিক্রি না করে বুড়ো গরুগুলোকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো গরুর সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে। এসব গরুর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, গ্রামীণ জনপদ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতে ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামীণ এলাকায়।
২০১২ সালে দেশটির গবাদিপশু–সংক্রান্ত জরিপে বলা হয়েছে, ছুটকো বা ভবঘুরে গরুর সংখ্যা ৫২ লাখ। প্রতি ১০ বছর পরপর এ জরিপ চালানো হয়। তাই এ সময়ে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা যায়।
মোদি ক্ষমতায় আসার পর গ্রাম ও শহরের ব্যস্ত সড়কে গরুগুলোকে অবাধে বিচরণ করতে দেখা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো প্লাস্টিক বা আবর্জনা খায় বা জাবর কাটতে থাকে।
২০১৫ সালে সরকারের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো গরুর কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
রাজস্থানের চুরু জেলার সাবেক গ্রামপ্রধান সুমের সিং পুনিয়া বলেন, গরুর সুরক্ষা থাকায় কেউ সেগুলোকে ছোঁয়ারও সাহস করেন না। গরুর আশ্রয়কেন্দ্রও যথেষ্ট পরিমাণে নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোতে এত ঠাসাঠাসি করে গরু রাখা হয় যে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো গরু মরে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হিন্দু। আমরা গরুকে আঘাত করতে চাই না। কিন্তু আমাদের এত সংখ্যক গরু রাখা ও খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য নেই। আমাদের নিজেদের খাবার জোগাতেই টানাটানি চলে।’
ভোটারদের অসন্তুষ্টি গতকালের ভোটও সাক্ষ্য দিয়েছে। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের মতো বড় কৃষি অঞ্চলে কংগ্রেসের কাছে হেরেছে বিজেপি।
রাজস্থানে দেশটির একমাত্র ‘গরু মন্ত্রী’ও বিতাড়িত হয়েছেন। ২০১৪ সালের পর এটাকে বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তন বলা যায়। সেবার ২৬ কোটি ২০ লাখ কৃষক বিজেপিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষি খাতের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবার বিজেপি।
ফসল বাঁচাতে, বিশেষ করে শস্য কাটার মৌসুমে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভবঘুরে গরুর পাল রাখার জন্য গ্রামবাসীর যাঁরা অর্থ জমা দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন সেই অর্থ তুলে নিচ্ছেন। গরুর হাত থেকে ফসল রক্ষায় উত্তরাঞ্চলের রাজ্য উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে জেলার স্কুলগুলোতে গড়ে তোলা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গরুগুলো আটকে রাখার জন্য অর্থ দিয়েছিলেন।
পিলানির সামাজিক সংগঠন গ্রাম্য ভারত জনচেতনা যাত্রার প্রধান সন্দীপ কাজলা এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্যই ভবঘুরে গরুর ইস্যুটি রাখা উচিত ছিল। একজন কৃষক একটি গরু দেখভাল করতে পারেন। কিন্তু সেখানে শত শত গরু ঘুরে বেড়ায়।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গুরপ্রিত মহাজনের ভাষায়, গরু নিয়ে বিবাদেই ধরা খেয়েছে বিজেপি। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, প্রত্যেকের এই একটি বিশেষ বিষয় (গরু) নিয়ে কী করা যায় এবং কীভাবে সেটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়, তা নিয়ে কোনো ভাবনা রয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.