অবৈধ বালু উত্তোলন: ধলাইয়ের প্রতিশোধ, ঝরে গেল ৬ প্রাণ by ওয়েছ খছরু

পাথরের পর বালু লুটপাটে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের উত্তাল ধলাই নদী। এরই মধ্যে ৬ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ভয়ঙ্কর ধলাই। উজানের ঢলে ধলাইয়ের এখন ভরা যৌবন। এই সময়ে এসে বালু লুট ও বালু নৌকার তাণ্ডব চলছে। এতে করে নদীতে দেখা দিয়েছে উত্তাল ঢেউ। আর ঢেউয়ের তোড়ে তলিয়ে যাচ্ছে বালু, যাত্রী ও পর্যটনবাহী নৌকা। কোম্পানীগঞ্জের প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে গত এক মাসে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বালু লুটপাট করা হয়েছে। এই লুটপাটে জড়িত আছে প্রভাবশালী সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
বালু সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৃশ্য কোম্পানীগঞ্জবাসী চোখে দেখলেও প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু একেক করে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় টনক নড়েছে মানুষের। বিষয়টি নজরে এসেছে জেলা প্রশাসনেরও। ইজারাদারের জায়গা আলাদাকরণের জন্য কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও নির্দেশ দিলেও তারা সেটি করছেন না। আর এই সুযোগে চাঁদাবাজরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন ১০-১২ লাখ টাকার চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ পাথরের জন্য যেমনি পরিচিত তেমনি রয়েছে বালুমহালও। বর্ষা এলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিজ দেয়া হয় ধলাই ও পিয়াইনের বালুমহাল। এবার তিনটি বালুমহালের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়া ভাটরাই মৌজায় বালু উত্তোলনের ইজারা পান। গত ঈদের পরপরই আপ্তাব আলী কালা মিয়াকে মহাল সমঝে দিলে বালু উত্তোলন শুরু করেন তিনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে- ভাটরাই মৌজা লিজ নিলেও পার্শ্ববর্তী ধলাই ও পিয়াইন মহাল থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বালু লুটপাটের মহোৎসব চলছে। তাদের হিসাব মতে- প্রতিদিন কম হলেও ১ হাজার নৌকা বালু বিক্রি করছেন সিন্ডিকেটরা। আর প্রতিটি নৌকার বালুর দাম হিসেবে নেয়া হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এতে দেখা গেছে, ৫০ লাখ টাকার বালু লুটপাট করা হচ্ছে। বালু লুটপাটে আপ্তাব আলী কালা মিয়ার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম ও তেলিখাল ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াদুদ আলফু মিয়ার পক্ষ জড়িত। এতে এক মাসে তারা প্রায় ১৫ কোটি টাকার বালু লুটপাট করেছে। এই বালুমহাল থেকে বালু নিয়ে আসার সময় পথে পথে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। আপ্তাব আলী কালা মিয়া, জাহাঙ্গীর আলম ও আলফু চেয়ারম্যানের লোকজন মিলে ৭-৮টি ঘাটে নৌকা বোঝাই বালু থেকে ১-২ হাজার টাকা করে চাঁদাবাজি করছে। এর বাইরে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি তাজুল ইসলামের পক্ষ থেকে সাদ্দাম ও দিলোয়ার নামের দুইজন  চাঁদাবাজি করছে। এই বালু লুটপাট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে স্থানীয় এমপি ও প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদের কাছে প্রকাশ্য সভায় অভিযোগ দিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাজী শামীম আহমদ। একই সঙ্গে তিনি কোম্পানীগঞ্জের ওসি তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেন। পাশাপাশি তিনি বৈধ ইজারা মহাল নির্ণয় করতে জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানান। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক দ্রুত বালুমহাল আলাদাকরণের নির্দেশ দেন। বার বার সময় পরিবর্তনে আজকালের মধ্যে ইউএনও মহাল পৃথকে নামবেন বলে প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাজী শামীম আহমদ জানিয়েছেন- ‘মন্ত্রীকে বলেছি, কোম্পানীগঞ্জকে চাঁদাবাজ মুক্ত করবো। পাশাপাশি সকল লুটপাট বন্ধ করবো। প্রশাসন কার্যকর না হলে জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আমি নামবো। এখন বালুখেকোরা কালাইরাগ ও কালা সাদেক এলাকায় লুটপাট চালাচ্ছে। এ কারণে নদীও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েছে। মানবিক বিপর্যয়ের আগেই ধলাইকে রক্ষা করতে হবে।’ এদিকে- পিয়াইন থেকে অবৈধ ভাবে বালু লুটপাট চালাচ্ছে ইপিসি নামের ঢাকার একটি কোম্পানি। বড় বড় ড্রেজার দিয়ে এই লুটপাট চালিয়ে বালু নিয়ে যাচ্ছে ওই কোম্পানির শ্রমিকরা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ কোম্পানীগঞ্জের ভাটরাই মৌজার ইজাদার আপ্তাব আলী কালা মিয়াও। তিনি বলেন- ‘ইপিসি কোম্পানী সহ কিছু বালুখেকো চক্র অবাধে লুটপাট চালাচ্ছে। আর সব দোষ দেয়া হচ্ছে আমাকে। এটা ঠিক নয়। কোম্পানীগঞ্জের প্রশাসন আমার ইজারার স্থানের বাইরে যারা বালু লুট করছে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এজন্য তিনি প্রশাসনের ওপরও ক্ষোভ ঝাড়েন।’ তবে- কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ইপিসি কোম্পানিকে বালু লুটপাটে নিষেধ দেয়া হয়েছে। বৈধতা নিয়ে এলে তারা বালু তোলতে পারবেন। তিনি নিজেও বালু লুটপাটের বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন- প্রশাসন অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও চাঁদাবাজি বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে। দ্রুতই বৈধ বালুমহালের সীমানা নির্ধারণ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান। এ ঘটনায় লুকোচুরি করছেন কোম্পানীগঞ্জের ওসি তাজুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দিয়েছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ। এরপরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। গতকালও কোম্পানীগঞ্জে তিনি টিভি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। নিজেকে আড়াল করে রাখেন তিনি। এদিকে- পাথরের পর কোম্পানীগঞ্জের বালুখেকো সিন্ডিকেটের অবাধ লুটপাটে প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে উঠেছে উত্তাল ধলাই নদী। হাজারো বালু বোঝাই নৌকা চলাচলের কারণে ধলাইয়ের ঢেউয়ে গত রোববার টুকের বাজার এলাকায় ডুবে যায় একটি বালু বোঝাই নৌকা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- রোববার বন্ধুদের সঙ্গে এই সাদাপাথরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়েছিলেন সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র হাসানুর রহমান আবির। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। একই দিনে খরস্রোতা ধলাইতে পৃথক নৌকাডুবির ঘটনায় আরো ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজনগর এলাকায় বালুভর্তি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ দুর্ঘটনায় নাঈম হোসেন ও জমির হোসেন নামে ২ বালু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এদিন সকাল থেকে টুকেরবাজার এলাকায় ধলাইর বুকে বালু বোঝাই ট্রলারের ঢেউয়ের তোড়ে তলিয়ে যায় একটি খেয়া নৌকা। এ সময় দুই শিশু নিখোঁজ হয়। সোমবার দুপুর ১টার দিকে উপজেলার নতুন বাজার ও বাংকারের মাঝামাঝিতে মরা ধলাই নদীতে খালি বলগেট নৌকার ধাক্কায় বালু বোঝাই আরেকটি বলগেট নৌকা ডুবে যায়। এ সময় ৩ জন মাঝি লাফ দিয়ে নিরাপদে গেলেও ভিতরে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন একজন। তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। এসব কারণে সাদাপাথর এলাকার পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক নেমে এসেছে। এ কারণে পর্যটকরা কম যাচ্ছে সাদাপাথরে।

No comments

Powered by Blogger.