শ্রীলংকায় কোন বিদেশী বাহিনীর ঘাঁটি হবে না, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সুদৃঢ় ঘোষণা

শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা গত শনিবার সুনির্দিষ্টভাবে আশস্ত করেছেন যে, তার শাসনামলে তিনি এমন কোন চুক্তি স্বাক্ষর হতে দিবেন না, যেটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। শ্রীলংকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এমন একটা চুক্তি করতে যাচ্ছে, যেটা শ্রীলংকায় ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ করে দেবে যুক্তরাষ্ট্রকে – এই ধরনের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ার কারনে প্রেসিডেন্ট এই আশ্বাস দিলেন।
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোফা চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা শুরুর পর যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা জোর দিয়ে বলেন, “দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে বা দেশের জন্য যেটা উপযুক্ত হবে না, আমার শাসনামলে এমন কোন চুক্তি বিশ্বের কোন শক্তির সাথে হতে দেবো না আমি”।
প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আরও বলেন, “যদিও সোফা ও মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ এবং একটি ভূমি আইন যেটা দেশের জন্য উপযোগি নয় – এ বিষয়গুলো নিয়ে সমাজে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু আমি এ ধরনের চুক্তির কোন সুযোগ দেবো না”।
এদিকে, গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, শ্রীলংকার কিছু এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকল্পের জন্য জমি পরিদর্শনের কাজও শুরু হয়ে গেছে।
শ্রীলংকায় ইস্টার সানডেতে আইসিস স্টাইলে হামলায় আড়াই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর, এই ধরনের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে যে, আমেরিকা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে শ্রীলংকায় তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারে এবং বর্তমান পশ্চিমা-পন্থী ইউএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই কিছু চুক্তি করে ফেলতে পারে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসার দল শ্রীলংকা পোদুজানা মেরামুনার (এসএলপিপি) পক্ষে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন গোতাভায়া রাজাপাকসা।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সিরিসেনা, তখন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মাত্র এক মেয়াদের জন্যই প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি। তবে এখন সেই থেকে ঘোষণা থেকে সরে এসেছেন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আকাঙ্ক্ষা এখনও তিনি ত্যাগ করেননি। তবে যে দলটিকে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। দলটির অধিকাংশ সদস্য এসএলপিপি দলের প্রতি অনুগত এবং তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য রাজাপাকসার নতুন দলে যোগ দিয়েছেন।
সিরিসেনা এদিকে, শ্রীলংকার সামনে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। শ্রীলংকার মাদক মাফিয়াদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযানে নেমেছেন এবং মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের বিতর্কিত আদেশও দিয়েছেন তিনি।
গত শনিবার এক জনসমাবেশে প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি মাদকের ভয়াবহতা দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেটা একটা জাতীয় বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে এবং মাদক পাচারকারীদের রক্ষায় এগিয়ে আসায় রাজনীতিবিদদের প্রতি দোষারোপ করেছেন তিনি।
সিরিসেনা বলেন, “এই দেশের নিরপরাধ শিশুদেরকে এই অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডের পরিণতি বহন করতে হবে”। তিনি আরও বলেন, যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আবেদন দায়ের করেছে, তাদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, তারা মাদক সম্রাটদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন।
৩০ অক্টোবর পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছে। এই আদেশের পরই প্রেসিডেন্ট ওই মন্তব্য করলেন।
সুপ্রিম কোর্ট কমিশনার জেনারেল অব প্রিজন্স ও বেলিকাদা প্রিজন সুপারিন্টেন্ডেন্টকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এখনই কোন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা না হয়।
প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা গত সপ্তাহে মিডিয়াকে বলেছিলেন যে, মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশে স্বাক্ষর করেছেন তিনি।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। যদিও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন আগে করার উপায় খুঁজছেন সিরিসেনা। সিরিসেনার দল এসএলএফপি গত বছরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় রাজাপাকসার এসএলপিপি দলের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়। এখন সেই এসএলপিপি দলের সাথেই জোট করার চেষ্টা করছে এসএলএফপি। জোট গড়ার বিষয়ে দুই দলের মধ্যে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে, তবে এসএলপিপি এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দুই দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও, সিরিসেনাকে সেখানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কোনভাবেই মেনে নেবে না। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সিরিসেনা ইউএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর জোটগত প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে ওই দলগুলোর সাথে সম্পর্ক ভালো নেই তারা।
এদিকে এসএলএফপি ও এসএলপিপি দলের মধ্যে সর্বশেষ আলোচনায় জোটের নামের ব্যাপারে নতুন একটা নাম প্রস্তাব করা হয়েছে এবং উভয় পক্ষই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। নতুন জোটের নামটা হলো শ্রীলংকা নিদাহাস পোদুজানা পেরামুনা। এটাও জানা গেছে যে, জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোর মতো বড় ইস্যুগুলো নিয়ে দুই দলের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে, যেটা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। তবে মজার ব্যাপার হলো এসএলএফপি এমন ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা সিরিসেনাকে প্রার্থী রেখে এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনও পুরোপুরি নাকচ করেনি।
এদিকে, এসএলএফপির কাছে ২৫ দফার একটি নীতি দলিল পেশ করেছে এসএলপিপি, যেটা বর্তমানে গ্রামীণ এলাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গ্রামীণ জনগণের সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য এই প্রচারণাটা চালানো হচ্ছে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে যে, এসএলএফপি এ ব্যাপারে একটি পাল্টা প্রস্তাবও দিয়েছে, যেখানে দুটো রাজনৈতিক দলিলেই সুশাসন, পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনৈতিক নীতি, অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এবং দুই দল জোটবদ্ধ হলে কিভাবে জোট পরিচালিত হবে, সে বিষয়েও মতামত রয়েছে।
তবে এটা জানা গেছে যে, এসএলএফপি যেটা নিয়ে দর কষাকষি করছে, সেটা হলো প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করতে হবে, যদিও এসএলপিপি এটা স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছে যে, এ ধরনের কোন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় তারা রাজি নয়।
তবে এসএলপিপি ক্যাম্পে তাদের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব গোতাভায়া রাজাপাকসা চিকিৎসার জন্য বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন এবং শিগগিরই তিনি সেখান থেকে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন যে, এসএলপিপিকে যদি রাজাপাকসা পরিবারের বাইরে থেকে কোন প্রার্থীকে বেছে নিতে হয়, তাহলে তাদের সম্ভাবনা কমে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.