ক্রিকেট তারকা, ‘সেক্স সিম্বল’ থেকে প্রধানমন্ত্রী

বিশ্ব ক্রিকেটের পিচ আর লন্ডনের নাইটক্লাব- সব খানেই বেশ নাম করেছিলেন ইমরান খান। তবে পাকিস্তানে রাজনীতির উঁচু পদে যেতে তার দুই দশকব্যাপী সংগ্রামের সময়টুকু তিনি এক জটিল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছেন। ইমরান খানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, সাম্প্রতিককালে তিনি কিছুটা রক্ষণশীল ইসলামকে আলিঙ্গন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। পাশাপাশি, নিজের পার্টি-জীবন থেকে দূরে সরেছেন। অবশ্য এখনও তার রাজনৈতিক দলের প্রতীক হলো ক্রিকেট ব্যাট।
দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার ফল তিনি অবশেষে পেয়েছেন। সাধারণ নির্বাচনে তার দল সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে। এখন পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রটির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তারই সবচেয়ে বেশি।
দেশজুড়ে ইমরান খানের সত্যিকার জনপ্রিয়তা রয়েছে। আবার দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও রয়েছে তার দহরম মহরম। ‘সেলিব্রেটি’ ইমেজ, ক্যারিশমা ও অর্থ- এই তিনের মিশেলে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। পাকিস্তানের মতো দরিদ্র দেশে মানুষ নানা কারণে বিভক্ত। কিন্তু দুর্নীতি হলো গুটিকয়েক ইস্যু যার বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষই ঐক্যবদ্ধ।
মানুষ দেখেছে দেশ যখন ঝুচছে, দেশের রাজনৈতিক বংশগুলো নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। শিশুমৃত্যুর হার এশিয়ায় পাকিস্তানের চেয়ে বেশি খুব কম জায়গায় আছে। দেশ থেকে প্রতি বছর অসংখ্য যুবক বিদেশে যায় গাড়িচালক ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে, কেননা দেশে ভালো কর্মসংস্থানের ভীষণ অভাব। ইমরান খান নিজেকে এই সকল রোগের প্রতিষেধক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
কর্নেল ইন্সটিটিউট অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক রেজা রুমি বলেন, ‘তার সঙ্গে সরাসরি কোনো দুর্নীতি কেলেঙ্কারির সংশ্লেষ নেই। যেটি পাকিস্তানি রাজনীতিকদের বেলায় বিরল একটা ব্যাপার।’ তবে এবার ইমরান খান যেই নির্বাচনী সাফল্য পেলেন, তার নেপথ্যে তার ক্লিন ইমেজই একমাত্র অনুঘটক ছিল না।
দেশটির সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে প্রভাব খাটিয়েছে। এমন প্রমাণ আছে ভুরিভুরি। ইমরানের প্রতিপক্ষরাই নয় শুধু, মানবাধিকার কর্মীরাও অভিযোগ করছেন, সামরিক বাহিনী বেছে বেছে ইমরানের প্রতিপক্ষ দলগুলোকেই টার্গেট করছে। গণমাধ্যম সমালোচনামুখর হলে তাদের টুঁটি চেপে ধরেছে।
বিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে দুই সপ্তাহ আগে কারান্তরীণ করা হয়েছে। এক বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট তাকে অপসারণ করে। উচ্চ আদালত সেনাবাহিনীর চাপে ওই রায় দিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন।
নওয়াজ শরীফের দলের অনেক সদস্যই পক্ষত্যাগ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, নওয়াজের দলকে পঙ্গু করে দিতে নিরাপত্তা বাহিনী এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে।
ইমরান খান ভারী গলায় কথা বলেন। কণ্ঠ থেকে আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ দেখা যায়। খুব বিনয়ীও। আবার তিনি সম্ভবত কারও রিমোট কন্ট্রোলের অধীন। তবে ইমরান জোর গলায় বলেন, তিনি সেনাবাহিনীর পকেটস্থ নন। যদিও তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থক। মাস কয়েক আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি একটি গণতান্ত্রিক সরকার নৈতিক কর্তৃত্ব থেকে দেশ শাসন করে। আপনার যদি ওই নৈতিক কর্তৃত্ব না থাকে, তাহলে যাদের পেশীশক্তি আছে তারাই উঠে আসে। আমার মতে, এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কোনো শত্রু সেনাবাহিনী নয়। আমি সেনাবাহিনীকে আমার সঙ্গে রাখবো।’
পাকিস্তানের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় সরাসরি সেনাশাসন বিরাজ ছিল। বেসামরিক সরকারের সময়ও সেনাবাহিনী রাজনৈতিক বিষয়ে গুরুতর হস্তক্ষেপ করেছে। ফলে ইমরান যখন নিজেকে স্বাধীন দাবি করেন, তখন অনেক বিশ্লেষকই সংশয় পোষণ করেন।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সি. ক্রিস্টাইন ফেয়ার বলেন, ‘সে হলো তাদের পুতুল। তিনি এখন যেখানে তা হলো আর্মি আর আইএসআই (সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা)-এর কারণে। নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে আর্মি আর আইএসআই ব্যাপক সক্রিয় ছিল। নির্বাচনের দিন থেকে শুরু করে পরের সময়গুলোতেও সক্রিয় থাকবে, যাতে ইমরান খানের নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় আসে।’
ইমরান খান তাহলে শাসন করবেন কিভাবে?
পাকিস্তানের জনসংখ্যা বিশ্বে ৬ নম্বর। আছে পারমাণবিক শক্তি। ভৌগোলিক দিক থেকেও উত্তপ্ত অঞ্চলে দেশটির অবস্থান। দেশটির সঙ্গে ভারতের রেষারেষি দীর্ঘদিনের। এছাড়া আফগান তালেবান সহ জঙ্গি প্রক্সিগুলোকে সমর্থন দেয় পাকিস্তান।
ইমরান বলেছেন, তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। তালেবানের কিছু কিছু সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। তবে প্রকাশ্যেই আবার এই গোষ্ঠী ও এর লক্ষ্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান বেশ কঠোর। পাকিস্তানে আমেরিকার ড্রোন হামলা নিয়ে তার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এছাড়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধকে তিনি পাগলামি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক ওমর ওয়ারাইস বলেন, ‘তার পররাষ্ট্রনীতির মূলে রয়েছে আমেরিকা-বিরোধিতা।’
তবে ঘরোয়া বিষয়াদিতে তাকে বেশ বেগ পেতে হবে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ক্রমেই অবনতিশীল। দেশের বিদ্যুত ও পানি সরবরাহ সহ রাষ্ট্রীয় অনেক সেবাখাতে সংকট চলছে।
ইমরান খান কেমন শাসক, সেই ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে তার দল ২০১৩ সাল থেকে স্বল্প জনসংখ্যার খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ শাসন করে আসছে। সেখানে দলটির পারফরম্যান্সের মান মিশ্র। তবে সরকারি সেবায় উন্নতি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন।
ইমরান বলেছিলেন, শীর্ষ দুই দল তথা পিপিপি ও পিএমএল (এন)-এর সঙ্গে জোট গঠন করবেন না। কারণ, তার মতে, এই দলগুলো প্রচ- দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে ইমরান যদি স্বতন্ত্র ও ছোট দলগুলোর সঙ্গে মিলে জোট গঠন করেন, তাতে পার্লামেন্ট হবে খুব দুর্বল ও খ-বিখ-।
৬৫ বছর বয়সী ইমরানের জীবন বেশ বর্ন্যাঢ্য। তবে প্রায়ই বদলেছে ধরণ।
জন্মেছিলেন বেশ অভিজাত পরিবারে। পড়াশুনা করেছেন অক্সফোর্ডে। বহু সুন্দরী ও বিখ্যাত নারীর প্রেমিক ছিলেন। আবার খেলোয়াড় হিসেবেও সুপারস্টার তকমাধারী। ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ভাবা হয় তাকে। ফলে বেশিরভাগ পাকিস্তানীর সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বে পাকিস্তান যখন বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারায়, তখন দেশে নায়কোচিত মর্যাদা পান তিনি। ওই মুহূর্ত ছিল তীব্র জাতীয় গৌরবের। আর এর কেন্দ্রে ছিলেন ইমরান। তখন তার বয়স ছিল ৩৯।
এর কয়েক বছর পরই ইমরানের জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। গরিব মানুষের জন্য ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে তিনি লাখ লাখ ডলার সংগ্রহ করেন। তার মা মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে। এরপর তিনি ইসলাম নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন। মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা প্রেমে মত্ত সেলিব্রেটি জীবন থেকে সরে আসেন। বললেন, এই ধরণের জীবনে কখনও সন্তুষ্টি নেই।
এক বৃটিশ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের প্রাক্তন রঙিন জীবন সম্পর্কে বলেন, ‘বাইরে থেকে এ জীবন দারুণ গ্ল্যামারাস মনে হয়। তবে আসলে তা এমন নয়। ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কগুলো খুবই ফাঁপা।’
১৯৯৬ সালে ইমরান প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস মুভমেন্ট। প্রথম কয়েক বছর তার এই দলকে কেউ চিনতোই না। আইনসভায় কোনো আসনই জিততো না। একটা সময় ইমরান সুপারস্টার থেকে হয়ে পড়লেন কৌতুকের পাত্র। ব্যাঙ্গ করে কেউ কেউ বলতেন, ‘ওসৎধহ কযধহ’ঃ।’ বরং, শীর্ষ দুই দল, অর্থাৎ নওয়াজের পিএমএল ও ভুট্টো পরিবারের পিপিপি ছিল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। দেশজুড়ে তাদের ছিল বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী। অনেক অঞ্চলে এখনও ভূস্বামী ও উপজাতি প্রধানদের প্রভাব ব্যাপক। এই বিশেষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবিশেষকে যদি কাক্সিক্ষত সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে ভোট পাওয়া যায় অনেক। ইমরানের নতুন রাজনৈতিক দল এখানটায় পিছিয়ে ছিল দীর্ঘদিন।
তবে ওই কঠিন সময়েও ইমরান কিছু ভক্ত জুটিয়েছিলেন। তার সমাবেশে অনেকে চিৎকার করে শ্লোগান দিতেন, ‘কে বাঁচাবে পাকিস্তান? ইমরান খান! ইমরান খান!’ আজ অনেক রক্ষণশীল মুসলিম তার বেয়াড়া অতীত জীবনকে অগ্রাহ্য করতে প্রস্তুত।
তানভীর হায়দার নামে এক পাকিস্তানী ক্রেন অপারেটর কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যে। এই সপ্তাহে তিনি দেশে উড়ে গেছেন শুধু ইমরানের দলকে ভোট দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘তিনি অতীতে কী ধরণের জীবনযাপন করতেন, সেটা তার ব্যাপার। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের জন্য তিনি কী করবেন। সব রাজনীতিকের চেয়ে তিনিই বেশি করবেন।’
পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মানুষজন পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। ইমরান এই পরিবর্তনেরই প্রতিনিধি। সাংবাদিক রেজা রুমি বলেন, ‘সবাই না হলেও শহুরে বাসিন্দাদের অনেকেই দুই শীর্ষ দলের ওপর বিরক্ত।’
তবে আর যা-ই হোক, নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও, ইমরান সেসব বেশ দৃঢ়ভাবেই মোকাবিলা করেছেন।
ইমরানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন জেমিমা গোল্ডস্মিথ। ইহুদী বংশোদ্ভূত জেমিমা ধনকুবেরের মেয়ে। তাকে বিয়ের পরপরই পাকিস্তানের অনেকে ইমরানের বিরদ্ধে যায়নবাদীদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অভিযোগ তোলে। এই অভিযোগ হেসেই উড়িয়ে দিতেন তিনি। ইমরানের দ্বিতীয় স্ত্রী সম্প্রতি আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি ইমরানের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অধ্যায় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তবে এসবকে পাত্তাই দেননি ইমরান। তার তৃতীয় ও বর্তমান স্ত্রী আধ্যাত্মিক হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে অনেক পাকিস্তানী বলাবলি শুরু করেছেন ইমরান ও তার স্ত্রীর কথিত আরাধনা পদ্ধতি নিয়ে।
ইমরান আসলে কীসের প্রতিনিধিত্ব করেন? এই প্রশ্নের জবাবে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক আশুতোষ ভার্শনে বলেন, ইমরান উন্মাদনা মাখা অসাধারণ এক খেলোয়াড়ি প্রতিভা। সংশোধনাতীত প্লেবয়। আর প্রতিশোধপরায়ণ উচ্চাকাঙ্খী এক রাজনীতিক। তিনি পাকিস্তানে গণতন্ত্র আনতে পারবেন না। গণতন্ত্রকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে হয়, সেনাবাহিনীকে অবশ্যই পিছু হটতে হবে।’ শেষ কথা হিসেবে ভার্শনে বলেন, ‘কোনো গণতন্ত্রই এভাবে কাজ করে না। নির্বাচন হোক, আর না হোক।’

No comments

Powered by Blogger.