পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ by মিজানুর রহমান

পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিস্তৃত পর্যালোচনা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বেলারুশ, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর মধ্য দিয়ে (কাছাকাছি অবস্থানে থাকা) দু’টি অঞ্চলের সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। বিশেষ করে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ। কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সেই তিমিরেই রয়েছে। এটি বাড়ানোর উদ্যোগ যে ছিল না, তা কিন্তু নয়। তবে সেই সব উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় বা গতি আনা সম্ভব হয়নি নানা কারণে। বর্তমান সরকারের আমলেও বহুবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটাকে কাঠামোবদ্ধকরণ বা প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়নি। সরকারের শেষ সময়ে হলেও সেগুনবাগিচা পুরনো সেই সম্পর্ককে একটি ‘ঝাঁকুনি’ দিতে চায়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে আগামী মাসের শেষের দিকে বেলারুশ, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশন বা পরামর্শ সভার আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
ওই প্রস্তুতি বিষয়ে গত সপ্তাহে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। যেখানে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তারা পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চলে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথাই জানান দেন। কর্মকর্তা বলেন, পূর্ব ইউরোপের দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতা অর্জন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পূণর্গঠনে মস্কোর অবস্থান অনস্বীকার্য। ৪৭ বছরে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী, কাছের এবং দূরের অনেক বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অংশীদারিত্ব, কৌশলগত অংশীদারিত্ব কিংবা তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধবন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সেটি হয়নি। যদিও গত বছর এবং চলতি বছরের এপ্রিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী মস্কো সফর করেছেন। চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি বরিসত। রাশিয়ার সহায়তায় পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এগিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দু’দেশ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ব্যাপারে মনোযোগ দিয়ে আসছে। ওই সময়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানির পাশাপাশি প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দু’দেশের সহযোগিতা অনেক বেড়েছে।
সেদিন এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব বলেন- ‘শক্তিমান’ রাশিয়া এশিয়ায় কীভাবে তাদের উপস্থিতির জানান দেবে এবং স্বল্প শক্তির ছোট দেশগুলোকে সাহায্য করবে সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ও রাশিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বহুলাংশে নির্ধারিত হবে। তার মতে, বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া জোরেশোরে ফিরে এসেছে। সচিব শহীদুল হক বলেন, রূপান্তরিত বিশ্বে সব কিছু দ্রুত আমূল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে রাশিয়াসহ অন্য শক্তিগুলো কোন পথে যাচ্ছে তা সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. এস এম সাইফুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। রাশিয়ান দূতাবাসের মিনিস্টার (কাউন্সিলর) সার্গেই এ পোপোভ বলেন, বাংলাদেশ ও রাশিয়া সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু এবং উভয় দেশ নিয়মিত রাজনৈতিক যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে।
ঢাকার কর্মকর্তা জানান, কেবল রাশিয়া নয় বরং দেশটির প্রতিবেশী ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়ানোর বাস্তব পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা। কর্মকর্তাদের মতে, পূর্ব ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বেলারুশ বরাবরই বাংলাদেশে সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মিনস্ক সফর করেছেন। বেলারুশের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে ১২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তিগুলোর মধ্যে ছিল বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পারস্পরিক সুরক্ষা, দু’দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিবিদদের ভিসা ছাড়া ভ্রমণের সুযোগ, বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড ও বেলারুশের সেন্টার ফর অ্যাক্রিডিটেশনের মধ্যে সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহযোগিতা বিনিময়, দু’দেশের মধ্যে সামরিক প্রযুক্তি বিনিময়, শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইএসএস) ও বেলারুশ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা। এছাড়া, দু’দেশের মধ্যে আইনগত সহযোগিতা বৃদ্ধি, ঢাকা ও মিনস্ক মহানগরীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন, সামুদ্রিক প্রাণিসম্পদ রপ্তানির ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স ও বেলারুশের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস ও বেলারুশের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে পৃথক পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ১৯৯১ সালে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর দু’দেশের মধ্যে ২০১২ সালেই ছিল প্রথম সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর। ওই সফরে বাংলাদেশকে জৈব ও পরমাণু প্রযুক্তি সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছিল বেলারুশ। পরের বছরে প্রধানমন্ত্রী মিনস্ক সফর করেন। এবং আগের বছরের সফরের ফলোআপ হিসেবে ফিরতি সেই সফর হয়।
লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক: ওদিকে বাল্টিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ লাটভিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তেমন এগুয়নি। ঢাকায় দেশটির এবং লটভিয়ায় বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলেট খোলার সিদ্ধান্ত হয় ২০১২ সালে। সেই বছরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দেশটি সফর করেন। দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকও সই করতে রাজি হয়েছিল ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন সত্তা লাভ করা লাটভিয়া। সেই থেকে দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার এবং শিক্ষা, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে ঢাকা। লাটভিয়ায় অত্যন্ত স্বল্পব্যয়ে ইউরোপীয় মানের চিকিৎসা, প্রকৌশল-প্রযুক্তি এবং ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চ শিক্ষার বিশাল সুযোগ আছে জানিয়ে এক কমকর্তা বলেন, দেশটিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করার ভালো অবস্থান অর্জন করতে পরে। লাটভিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের নেতৃত্বাধীন আসন্ন পরামর্শ সভায় আলোচনা হবে। ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ লিথুয়ানিয়ায় ইইউর সঙ্গে ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ লিথুয়ানিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। মস্কোতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় দেখাশোনা করে। বাংলাদেশে লিথুয়ানিয়ার একটি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে তা এখনও পূর্ণতা পায়নি।
লিথুয়ানিয়ার শীর্ষ নেতত্বের একটি সফর নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা চলছে। ওই সফরটি হলে ঢাকায় দূতাবাসসহ কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেত। ১৯৯২ সাল থেকে লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক চলে আসছে। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে। বাংলাদেশ লিথুয়ানিয়া থেকে দুগ্ধ সামগ্রী, বস্ত্র, সুতা ও প্রকৌশল সামগ্রী আমদানি করে এবং লিথুয়ানিয়ায় নিটওয়্যার, ফুটওয়্যার সামগ্রী, চামড়া, হস্তশিল্প, খেলনা সামগ্রী ও সিগারেট রপ্তানি করে। গত তিন বছরে লিথুয়ানিয়ায় বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি ছিল ৩.৫ মিলিয়ন ডলার, আমদানি প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার। দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের আশা করে এক কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন এফওসিতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

No comments

Powered by Blogger.