দুই শিবিরের প্রচারণার লড়াই by কাফি কামাল, ইকবাল আহমেদ সরকার ও এমএ হায়দার সরকার

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণের বাকি আর মাত্র ১২ দিন। গ্রীষ্মের প্রথম পর্বে প্রখর রোদ পরক্ষণেই বৈশাখী হাওয়াসহ তুমুল বৃষ্টি। প্রকৃতির এমন খেলা চলছে প্রতিদিন। বৃষ্টি নামলেই কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে খানাখন্দে ভরা রাস্তাগুলো। সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নের রাস্তাঘাটগুলোর পরিস্থিতি হয় অবর্ণনীয়। কোনোটিতে জমে কাদা, কোনোটি তলিয়ে যায় হাঁটুজলে। কিন্তু রোদ-বৃষ্টি কিছুই ঠেকাতে পারছে না মেয়র প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের প্রচারণায় রীতিমতো মুখরিত গাজীপুর সিটি। গানে গানে, স্লোগানে স্লোগানে দুই প্রার্থীর প্রচারণা চলছে সমানতালে, প্রতিযোগিতার মনোভাবে। মাইকে স্লোগান বাজিয়ে, ভোট চেয়ে নগরীর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চক্কর কাটছে দুই প্রার্থীর প্রচারযান। কাদা মাড়িয়ে, জলে ভিজে প্রার্থী ও দুই দলের নেতারা যাচ্ছেন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে। ভোটারদের হাতে হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রার্থীর লিফলেট। মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীরাও নেমেছেন প্রচারাভিযানে। সবমিলিয়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে শ্রমিক অধ্যুষিত শিল্পাঞ্চল কেন্দ্রিক এ সিটি করপোরেশনে। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রতিদিনই প্রতিটি ওয়ার্ডে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে একেকটি টিম। প্রার্থীর চেয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়ে নেমেছেন প্রচারণার মাঠে। বিশেষ করে খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকা ও জাতীয় নির্বাচনের বছরে এ সিটি নির্বাচন হওয়ায় সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অন্তঃকোন্দল ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি নেতারা। ধানের শীষের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে প্রচারণায় দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়, জোটের সমন্বয়, নির্বাচন পরিচালনা তিন কমিটির অধীনে জোন-ওয়ার্ড ও কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতিদিনই একজন এক বা একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা একেকটি ওয়ার্ডে যাচ্ছেন। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এ সিটিতে রয়েছে সারা দেশের মানুষের বসবাস। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে তাই গাজীপুর ছুটে যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলা বিএনপি নেতারা। ভোটের আগে আওয়ামী লীগকে প্রচারণার মাঠেই পরীক্ষায় ফেলতে চায় বিএনপি। কমিটি গঠন করে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার মাঠে নেমেছেন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও। হাসান উদ্দিন সরকারকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম জেলা নেতাদের নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে গণসংযোগ করছেন। তবে তার পক্ষে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের উপস্থিতি কিছুটা কম। আওয়ামী লীগের পক্ষে এখনও সক্রিয় ভূমিকায় প্রচারণায় নামেনি মহাজোটের নেতারা। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের নানা বয়সী ভোটাররা জানিয়েছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় একটি লক্ষণীয় পার্থক্য আছে। এবারের নির্বাচনী প্রচারণা দেখে মনে হয়, বিএনপি বনাম জাহাঙ্গীরের লড়াই হচ্ছে। এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দুই প্রধান দলের মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান উদ্দীন সরকার নির্বাচনী প্রচারে নেমে পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, বিএনপি বহিরাগতদের এনে প্রচারে নামিয়ে গাজীপুরের নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলতে চাইছে। তবে বিএনপি প্রার্থী এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আওয়ামী লীগই প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে লঙ্ঘন করছেন আচরণবিধি। প্রার্থী ও ভোটার সবারই চাওয়া একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়ার অভিযোগ ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র  প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তিনি। প্রত্যাহারের দাবিতে গত রোববার টঙ্গীতে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নির্বাচনী বিধিভঙ্গ করছেন প্রতিনিয়ত। এখনও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিশাল আকারের রঙিন বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে তার। ওদিকে আসন্ন সিটি নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকদিন আগে গাজীপুর সফর করেছেন মার্কিন দূতাবাসের একটি প্রতিনিধি দল।  রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সিলর বিল মোলার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলটি পর্যবেক্ষণ ও বিএনপি দলীয় প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার এবং আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তারা সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে চলে আসা গণতন্ত্রের ধারাবাহিক চর্চা অক্ষুণ্ন এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চান।
প্রচার নিয়ে পাল্টাপাল্টি
আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম সকালে নগরের এক নম্বর ওয়ার্ডের মাধবপুর এলাকা থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। আর বিএনপি প্রার্থী দুপুর পর্যন্ত তার নিজ বাসায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে নির্বাচনী পরামর্শ ও মতবিনিময় সভা করেন। অন্যদিকে, এই দুজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও অন্য পাঁচজন মেয়র প্রার্থী, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুটিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ভোট প্রার্থনা করছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম সকাল আটটায় নগরের ছয়দানা এলাকার নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরের মাধবপুরে প্রতীক নৌকা আর নেতা-কর্মীদের মিছিলসহ গণসংযোগ ও পথসভা করেন। জাহাঙ্গীর আলম নগরের ১, ২, ৩ ও ৪ নং ওয়ার্ডে দিনভর নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। এ সময় তিনি নির্বাচিত হলে সবধরনের নাগরিক সুবিধার জন্য কাজ করবেন বলে ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দেন পথসভায়। নৌকার এই মেয়র প্রার্থী যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই বিপুল সংখ্যক লোকজনের সমাগম ঘটছে। নির্বাচনী আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে কোথাও কোথাও বিপুলসংখ্যক মোটর সাইকেলসহ নানা ধারণের গাড়ির বহর ছুটছে তার গণসংযোগের বহরে। কোথাও কোথাও তার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে তাকে বরণ করা হচ্ছে ফুল ছিটিয়ে। অনেক জায়গায় বিশাল আকারের নৌকা হাতে নিয়ে তাকে বরণ করে নিচ্ছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। নৌকার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে গোটা এলাকা। গণসংযোগকালে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিফলেট ও প্রচারণাসামগ্রী বিতরণ এবং ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন তিনি। এসময় তিনি বিএনপির দলীয় বর্তমান নগরের মেয়র প্রফেসর এমএ মান্নানের নানা সমালোচনা করে বলেন, তার আমলে এলাকায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। এজন্য নগরের সব এলাকার রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। বর্তমান মেয়রের সমালোচনা ছাড়াও এর আগে তিনি বিভিন্ন স্থানে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নানা সমালোচনা করে বলেন, তাদের জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় কর্মী-সমর্থক একেবারেই কম থাকায় বহিরাগত লোকজন এনে প্রচার চালাচ্ছেন। এমন লোকজন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন যাদের বিরুদ্ধে নাশকতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা রয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার দাবি করেছেন, প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগই নির্বাচনী বিধিবিধান অমান্য করছে। এছাড়া তার নির্বাচনী প্রচারে বহিরাগতদের অংশগ্রহণের বিষয়ে জাহাঙ্গীরের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের নগরের বাইরের এলাকার দলের নেতাদের প্রচারণায় আইনি কোনো বাধা নেই। যেকোনো নাগরিকই তো প্রচারণায় অংশ নিতে পারে। বিএনপির মেয়রের আমলে উন্নয়ন না হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, একের পর এক মামলা দিয়ে হয়রানি করে কারাগারে আটক রাখার কারণেই বিএনপির মেয়র প্রফেসর মান্নান কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি।
প্রচারণায় ক্লান্তিহীন প্রার্থী ও নেতারা 
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম মে দিবসে মঙ্গলবার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের চান্নায় নির্বাচনী প্রচারণায় যান। এসময় এক পথসভায় শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করুন, গাজীপুরকে ক্লিন এবং গ্রিন সিটি উপহার দেব। আগামী ১৫ই মে আপনাদের সবার কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। গত দুদিন সরকারি ছুটি থাকায় দিনব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি গতকাল সকাল থেকে সিটি করপোরেশনের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ এবং পথসভার মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের ভোট চান।
এদিকে মঙ্গলবার রাত জেগে শবে কদরের ইবাদত-বন্দেগির কারণে বুধবার দুপুরের আগে কোন কর্মসূচি রাখেননি ২০দলীয় জোট মেয়রপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার। তবে দুপুরের আগে তিনি কয়েকটি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেন। এরপর বিকাল ৩টা থেকে তিনি নির্বাচনী মাঠে নামেন। বিকাল ৩টায় টঙ্গী ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফকির মার্কেটে পথসভার মাধ্যমে তিনি বুধবারের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। এরপর বৃষ্টি ও ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে বিকাল সাড়ে ৩টায় পাগাড় ঝিনু মার্কেট, সালামের আটারকল বিকাল ৪টায়, ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের গোপালপুরে সাড়ে ৪টায়, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের টিঅ্যান্ডটি গেটে সোয়া ৫টায়, শিলমুন স্কুল মাঠে পৌনে ৬টায় ও মরকুন প্রাইমারি স্কুল মাঠে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন। এদিকে মঙ্গল ও বুধবার বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে সারা দিন নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

No comments

Powered by Blogger.