বিওটির আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরতে ১৪ নির্দেশনা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাস্টি বোর্ডের অর্থ আত্মসাৎ ঠেকাতে ১৪ নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের ১৬ দফায় নির্দেশনার পর এসব নির্দেশনা দিলো মন্ত্রণালয়। এগুলো পুরো বাস্তবায়ন হলে আটকে যাবে বিওটির আত্মসাৎসহ আর্থিক কেলেঙ্কারি। নির্দেশনার মধ্যে অন্যতম হলো সরকারের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়েই অডিট করানো। এর ব্যত্যয় হলেই আটকে যাবে বিষয় অনুমোদন থেকে সমাবর্তনের অনুমতি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন আটকে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
কর্মকর্তারা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিসিদের সঙ্গে আচার্য ও প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ বৈঠক করে ১৬ দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টি। এটিকে সামনে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এমন উদ্যোগ নিয়েছে ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইন ২০১০-এর ৪৫ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অডিট করাতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এ আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের পছন্দে অডিট ফার্ম দিয়ে দায়সারা অডিট রিপোর্ট জমা দিতো। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটুকু করেনি। তারা বছরের পর বছর আর্থিক কোনো রিপোর্ট ইউজিসিকে না দিয়ে বিওটির অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল করছে। বার্ষিক আয় ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা (অডিট) জমা না দেয়ায় কারও বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছিল না। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে এই কঠোর উদ্যোগ। কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘নো লস, নো প্রফিট’ ধারনা নিয়ে চলার কথা থাকলেও অধিকাংশই এখন লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে বিওটি সদস্যরা। তারা সদস্যরা নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ইউজিসি গত ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের নির্ধারিত সিএ ফার্ম দিয়ে অডিট রিপোর্ট দেয়া নির্দেশ দিলেও বেশির ভাই তা দেয়নি। ইউজিসির পর এবার শিক্ষামন্ত্রণালয় তাদের নির্দেশনা দিয়েছে। এবার যারা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি বাতিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির কারাদণ্ড বা অর্থ জরিমানা বা উভয় দণ্ডে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে।
এ ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, আইনে পরিষ্কার বলা আছে প্রতি বছর অডিট রিপোর্ট ইউজিসিতে জমা দিতে হবে। কিন্তু এটা কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করছে না। শুধু তাই নয়, তাদের পছন্দের সিএ ফার্ম দিয়ে অডিট করিয়ে রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। এটা মোটেও কাম্য নয়। এ ধরনের ব্যত্যয় ঠেকাতে আমরা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি সরকারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে অডিট করাতে হবে। যারা ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইউজিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রায় দুই যুগ আগে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি)। ২৩ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট  রিপোর্ট ইউজিসিতে জমা দেয়নি। আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়টির হিসাব নিরীক্ষা করানো হয় কিনা, সে তথ্যও ইউজিসিতে নেই। ইউএসটিসি প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর নিজে নিজে বনে যাওয়া বিওটি চেয়ারম্যান ইফতেখার ইসলাম ৫ বছরে প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাকে মদত দিচ্ছেন ট্রাস্টি বোর্ডে তার আশীর্বাদপুষ্ট আরো কয়েকজন সদস্য। সর্বশেষ ৭৫ আসনের বিপরীতে ৪৫০জন শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে সরকারকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা পর্যন্ত দিয়েছে। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের এক মেয়ে বিষয়টির প্রতিবাদ করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বের করে দেয়ার পাঁয়তারা করার অভিযোগ করেছেন তিনি। এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়রি পর্যন্ত করেছেন ভুক্তভোগী ডা. নীনা ইসলাম। প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অডিট রিপোর্ট জমা দেয়নি। ৯৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষিত অডিট রিপোর্টের হালনাগাদ তথ্য রয়েছে। বাকিগুলোর অডিট রিপোর্ট অনিয়মিত। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শুধু জমি কেনার নামে সাড়ে ৬শ’ কোটি  টাকা আত্মসাৎ করেছে বিওটি।  এসব আর্থিক অনিয়ম বন্ধে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জিন্নাত রেহেনা ১৪টি ক্যাটাগরিতে নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করা নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে অডিট করে তা শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে দিতে হবে। ইতিমধ্যে ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ চিঠি দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদের এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। অডিট নির্দেশনায় মধ্যে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক কার্যক্রম ব্যাংকে পরিচালিত হয় কী না, কেনাকাটা ও ব্যয়ের ভাউচার যাচাই, সব আয় ব্যয় নির্দিষ্ট খাতে হয় কি না, না হলে কবে নাগাদ চালু হবে তা নির্ধারণ করা, বিবিধ ব্যয় দেখিয়ে ব্যয়ের খাত গোপন হয় না তা পরীক্ষা করা, আর্থিক লেনদেনে লেজার সংরক্ষণ না হলে কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিদিষ্ট করা, যারা ব্যাংক ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ নগদ টাকা আদায় করে পরবর্তীতে তা ব্যাংকে জমা হয় কি না এবং ছাপানো রশিদ বইয়ের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করা হয় কি না তা যাচাই করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভূমি, ইমারত, ব্যাংকের স্থায়ী আমানত, মূল্যবান যন্ত্রপাতি, যানবাহন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কেনা ও রেজিস্ট্রেশন হয় কি না, না হলে কার নামে তার উল্লেখ করতে হবে, ব্যাংকের হিসাব কে কে পরিচালনা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ তহবিল থেকে উৎসারিত আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হয় কি না, হিসাব বিবরণীতে অন্যান্য আয়-ব্যয় দেখানো হলে তা বিস্তারিত বিবরণ দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক পারফমেন্স সম্পর্কে মন্তব্য করা, পূর্বের কোনো মন্তব্য থাকলে তার বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, ভ্যাট, আইটি আর্থিক বিধি মাফিক কর্তন করা হয় কি না তা নিশ্চিত করা, স্থায়ী আমানত এর বিপরীতে কোনো ব্যাংক ঋণ নিয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তা কোনো ব্যক্তির নামে হয়েছে কি না তা খোঁজে বের। করা এ ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৫ (১) অনুযায়ী প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ব্যয়ের হিসাব ইউজিসির নির্ধারিত ফর্মে প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করা হয় কি না তা যাচাই করা। শিক্ষামন্ত্রণালয় সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি ২০১৭-১৯ থেকে পরবর্তী আরো দুই বছরের অডিটর নিয়োগের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এর আগে ২০০৪-০৫ থৈকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত অর্থ বছরের হিসাব নিরীক্ষার জন্য অডিটর নিয়োগের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আবেদন করেন। আগের অডিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে অডিটর নিয়োগ করা হয়নি। একই ধরনের জটিলতায় পড়বে অডিট অনিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আগের বছরের অডিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে সমাবর্তন করার অনুমতি দেয়া হবে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.