স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন চন্দ্রমহল by রবিউল ইসলাম

সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে যেমন স্থাপন করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল। তেমনি বাগেরহাট সদর উপজেলার খাঁনপুর ইউনিয়নের এক ব্যবসায়ী তার স্ত্রী নাসিমা হুদা চন্দ্রার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে স্থাপন করেছে চন্দ্রমহল। রনজিৎপুর গ্রামে স্থাপিত চন্দ্রমহলটি এখন ইকোপার্ক হিসেবে দেশি বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। এখাতে প্রতিদিন বেড়াতে আসেন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক। সুন্দরবনে যাওয়ার পথে খুলনা-মংলা মহাসড়কের পাশে ইকোপার্কটির অবস্থান। তাই সুন্দরবন ভ্রমণকারী দর্শনার্থীদের আরো বাড়তি আনন্দ যুক্ত করে এই চন্দ্রমহল।
রনজিৎপুর গ্রামে ৩৫ একর জমির ওপর এই চন্দ্রমহল তৈরি করা হয়েছে। দোতলা চন্দ্র মহলে প্রবেশ করতে হয় পানির নিচ দিয়ে তৈরি সুড়ঙ্গ পথে। ইকোপার্কে আরো আছে সারি সারি নারিকেল গাছ, নানা প্রজাতির গাছ, পিকনিক স্পট ও বেশ কয়েকটি পুকুর। আর পুকুরে রয়েছে ময়ূরপঙ্খী নৌকার উপর ভাসমান মঞ্চ, মহল জুড়ে রয়েছে নানা স্থাপত্যশৈলীসহ পূর্ব পুরুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ডাকটিকেট, মূদ্রা, তলোয়ারসহ আকর্ষণীয় অনেক মালপত্র। আরো রয়েছে হরিণ, কুমির, বানর ও পাখিসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য, বিলুপ্ত রূপসা-বাগেরহাট রেল লাইনের প্রতিকৃতি।

বাগেরহাট সদরের ঐতিহ্যবাহী হাকিমপুর গ্রামের ব্যবসায়ী সৈয়দ আমানুল হুদা তার ৩৫ একর জমির উপর গড়ে তুলেছেন চন্দ্রমহল নামের এই নয়নাভিরাম ইকো পার্ক। পার্কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। তার স্ত্রীর চন্দ্রার নামে মূল ভবনটির নামকরণ করেন “চন্দ্রমহল”। এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০০৯ সালে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের একটি নামকরা পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
 মূল ভবনটি ছাড়াও পুরো এলাকাটি ফুল ও ফলজ বৃক্ষ দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। এছাড়া এখানে ভাস্কর্যের মাধ্যমে দেশীয় সাংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে সাজানো পুকুরে মাছ চাষ হয়। একটি মিনি চিড়িয়াখানাও রয়েছে। ভবনটির অভ্যান্তরে হুদা পরিবারের সংগ্রহীত বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শিত করা হয়েছে। এখানে গ্রাম্য মানুষের চরিত্র নিয়ে প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি। আদি আসবাবপত্র আর তৈজশপত্র ছাড়াও কিছু স্থির ছবি রয়েছে এখানে। আরো রয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, মাষ্টার দা সূর্য সেন, বেগম রোকেয়া, আতাউল গনি ওসমানী, মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য।
চন্দ্রমহলটি মূলত তাজমহলের আদলে তৈরি। মহলটির সৌন্দর্য দেখে যে কোনো পর্যটক মুগ্ধ হবেন। বিশেষ করে প্রখর রোদের আলো যখন মহলের উপরি সোনালী অংশে পড়ে তখন এটি আর চমৎকার দেখায়।
মহলের চারিপার্শ্বে স্বচ্ছ পানির লেক। পানির নিচে গ্লাস দ্বারা বেষ্টনি করা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে মহলে প্রবেশ করতে হয়। এর দুই পার্শ্বের স্বচ্ছ পানির মধ্যে মাছের খেলা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। মহল জুড়ে রয়েছে নানা স্থাপত্য শৈলী। বের হওয়ার জন্য বাঁশের পুল রয়েছে। যা কারুকার্য্য করা। যে কারণে অন্যান্য পার্কের তুলনায় চন্দ্র মহলে পর্যটকদের ভীড় কিছুটা বেশি। জেলে, কৃষক, ধোপা ইত্যাকার নানান পেশাজীবী গ্রামীন মানুষের মধ্যযুগের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তার ধারণা দিতেই নির্মিত হয়েছে এখানে মাটির কারুকার্য্য সম্বলিত শিল্প। পানির উপর বাঁশের তৈরি রেস্তোরা। পুকুরের মধ্যে ইট-সিমেন্টের তৈরি কাঁকড়া ও ঝিনুক, পানসী নৌকা।
বন্য প্রাণীদের সাথে পরিচয় করানোর জন্য এখানে রয়েছে বানর, বনবিড়াল, হরিণ, তিতপাখি, তুর্কী মোরগ, সাদা বক, ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর, ঈগল, মদন টাক পাখি, সাদা ঘুঘু, হাঁস, পেঁচা, বেজী, কবুতর, কোয়েল, কুমির ইত্যাদি।
চন্দ্রমহলের ম্যানেজার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন জানান, মহলের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আমানুল হুদা সেলিম বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। বাগেরহাট সদর উপজেলার খাঁনপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর গ্রামের সৈয়দ আনোয়ারুল হুদার বড় ছেলে তিনি। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। অষ্ট্রেলিয়ায় জাহাজে চাকুরির সুযোগ পান তিনি। পরে দেশে এসে ঢাকায় গার্মেন্টস্ ব্যবসার পাশাপাশি নিজ এলাকায় চন্দ্রমহল প্রতিষ্ঠা করেন। ছোট বেলায় ফুফু শিরিনা বেগমের সাথে তাজমহল দর্শনের সুযোগ পান তিনি। সেখানে তাজমহল দর্শনের পর থেকে তার স্বপ্ন তাজমহলের আদলে একটি মহল তৈরি করার। পরে কর্মজীবনে এসে যখন সেই সুযোগ সৃষ্টি হয় তখন আর পেছনে ফিরে তাকাননি। স্বপ্ন পূরণে উঠে পড়ে লেগে যান। আর তাজ মহল নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে স্ত্রী নাসিমা হুদা চন্দ্রার নাম স্মরণীয় করে রাখতে গড়ে তোলেন চন্দ্রমহল।
চন্দ্রামহলের প্রবেশ মূল্য বর্তমানে ৫০ টাকা। এই মহল এখন দক্ষিণাঞ্চলে আগত হাজার হাজার পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.