জীবন দিয়ে স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ জানালো পান্না by মাহবুব খান বাবুল

তফুরা আক্তার পান্না। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন এ বছর। অপেক্ষায় ফলাফলের। বিয়ে হয়েছে মাত্র ৪ মাস। বিয়ের দেড় মাস পরই স্বামী ইমরান চলে যান প্রবাসে। ইমরানের পরকীয়া ছিল তার এক মামাত বোনের সঙ্গে। পান্নার সামনেই রাতে মুঠোফোনে ইমরান নিয়মিত কথা বলত ওই মেয়ের সঙ্গে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করত। কিন্তু পরিবারের লোকজনের কাছে স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করত। তারপরও অনেকেই জেনে গিয়েছিল। এক সময় স্বামীর পরকীয়া খুব বেশি আহত করে পান্নাকে। তার ওপর আবার যৌতুকের চাপ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দেবর সাদেকের আপত্তিকর প্রস্তাব। শাশুড়ি রওশন আরা (৫০) ও ননদ বিউটির (১৬) অসহনীয় যন্ত্রণা। সব মিলে মন ভেঙে গিয়েছিল পান্নার। পিতৃহীন পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। সাংসারিক জীবনে অশান্তির লোনা জলে ভাসছিল পান্না। সব শেষে রোববার নিজের জীবন দিয়েই স্বামীর পরকীয়া ও যৌতুকের চাপের প্রতিবাদ জানাল পান্না। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ গ্রামে। নিহত পান্নার পারিবারিক সূত্র জানায়, পান্না যখন জগদিশপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাণিজ্য বিভাগ থেকে ২০১৮ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। সেই সময়ে বাজে তার বিয়ের ঘণ্টা। মাত্র ৪ মাস আগে ২০১৭ সালের ২৩শে নভেম্বর পূর্বভাগ গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হাবিব উল্লাহর সৌদী প্রবাসী ছেলে মো. ইমরান মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার পশ্চিম বেজোরা গ্রামের মৃত শাহআলম খানের কন্যা পান্নার। ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে পান্না চতুর্থ। বিয়েতে কথামত অন্যান্য সরঞ্জামের সঙ্গে যৌতুক বাবদ ফার্নিসার দেয়ার কথাও ছিল। সামর্থ্য না থাকায় ফার্নিসার ছিল বকেয়া। বিয়ের পর থেকেই ইমরান তার সাবেক প্রেমিকার পরকীয়ায় ছিল লিপ্ত। মানসম্মানের ভয়ে স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি নিজের বুকে ধারণ করে স্বজনদের কাছে চেপে যেত পান্না। পরকীয়ার পাশাপাশি স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন যৌতুক বাবদ বকেয়া ফার্নিসারের জন্য পান্নাকে চাপ দিতে থাকেন। আবার ছিল দেবর সাদেকের অনৈতিক প্রস্তাবের খড়গ। দেড় মাস আগে স্বামী ইমরান ফের প্রবাসে চলে যান। এরপর পান্নার অশান্তির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। গত ৮ই এপ্রিল রোববার নিজের শয়ন কক্ষে গলায় রশি দিয়ে বৈদ্যুতিক ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। হাতের মেহেদি শুকানোর আগেই যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিজেই দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছে আত্মহত্যা। আর পান্নার বাবার বাড়ির লোকজনের অভিযোগ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
মুঠোফোনে যে যন্ত্রণার কথা বলেছিল পান্না: আগের দিন শনিবার সকাল ১১টার দিকে বড় বোন জহুরা বেগম ফোন দিয়েছিলেন পান্নাকে। ফোন ধরেই পান্না বলছিল ‘আপা আর পারছি না। আমাকে বাড়িতে নিবে না? কি করব ভেবে পাচ্ছি না। রাতে ডিস্টার্ব করে দেবর। দিনে শাশুড়ি ও ননদ। কাজ শেষ করে বসা দেখলেই তারা আমার ওপর মানসিক নির্যাতন চালায়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলেও শান্তি নেই। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেই ফোন রেখে দেয়। পান্নার বড় বোনের স্বামী জানান, ইমরানের সঙ্গে তার এক মামাত বোনের সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই বাকবিতণ্ডা হতো। ইমরান প্রবাসে চলে যাওয়ার পর পান্নার ওপর স্বামীর বাড়ির লোকজনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ঘটনার দিন ভোর বেলা পান্নার দেবর সাদেক বাড়ি থেকে চলে যায়। নিহত পান্নার বড় বোন জহুরা খানম বলেন, বিয়ের ১৫ দিন পরই রাতে পান্নাকে পাশে রেখেই ইমরান তার মামাত বোনের সঙ্গে মুঠোফোনে দীর্ঘ সময় হাস্যরসের কথা বলেন। পাশের কক্ষ থেকে আমি সব শুনেছি। সকালে পান্না ঘটনাটি স্বীকার করে ইমরানকে জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করে। আর দেবর সাদেক প্রায়ই পান্নাকে বলত ‘তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। যেকোনো কারণে ভাইয়ের সঙ্গে হয়ে গেছে। একই কথা।’ এমনসব কথা বলে পান্নাকে অনৈতিক প্রস্তাবও দিত। পান্নাকে অবসর দেখলেই মানসিক নির্যাতন করত শাশুড়ি ও ননদ। স্বামীর কাছে বিচার দিলে উল্টো গালমন্দ শুনতে হতো পান্নাকে। নাসিরনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবু জাফর বলেন, এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এখনো কেউ লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.