৬ কোম্পানির আওতায় আসছে নগরপরিবহন by আব্দুল আলীম

নগরপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকার ভেতরে চলমান সিটি বাসগুলোর ৩৫৯টি রুটকে মাত্র ২২টি রুটে বিন্যাস করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। অন্যদিকে এসব রুটে বিদ্যমান ৩০০টির বেশি বাস কোম্পানিকে মাত্র ৬টি কোম্পানিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। এই কোম্পানিগুলোর নাম দেয়া হচ্ছে যথাক্রমে পিংক সার্ভিস, ব্লু সার্ভিস, পেস্ট সার্ভিস, অরেঞ্জ সার্ভিস, ইয়েলো সার্ভিস ও গ্রিন সার্ভিস। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প ‘বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় এ ছয় কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে নগরপরিবহনগুলো। প্রকল্পের কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত ‘পিংক সার্ভিস’ কোম্পানির চলমান এলাকার মধ্যে বর্তমানে ৩৪টি কোম্পানির গাড়ি চলমান। কোম্পানিগুলো হলো- বলাকা সার্ভিস/লিংক, ঢাকা পরিবহন, ৬ নম্বর, ভেলিসিটি, তাজিকো প্রাইভেট লি., ট্রান্স সিলভা, সালসাবিল, সেভেরাল প্রোপাইটরস (কোনাবাড়ি থেকে সায়েদাবাদ), ব্লু বার্ড এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট কোম্পানি লি., অনাবিল সুপার, গ্রেট তুরাগ, অনাবিল, গুলশান এক্সপ্রেস, ওয়াইশিয়া পরিবহন লি., রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, সেভেরাল ওনার্স, নাগরিক পরিবহন, স্কাই লাইন, প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন, গাজীপুর পরিবহন, সিনো-দিপন, মধুমতি ফাউন্ডেশন লি., দিবানিশি পরিবহন, আবাবিল, এবি ব্রাদার্স, বোরাক পরিবহন, ওমামা (এসি বাস), বেস্ট শতাব্দী পরিবহন, বেঙ্গল মোটরস, নিউ দেশ বাংলা, কনক পরিবহন, বসুমতি, পল্লবী সুপার সার্ভিস ও জাবেদ ট্রান্সপোর্ট।
এসব কোম্পানির গাড়িগুলো বর্তমানে ৪৬টি রুটে চলাচল করছে। যাকে মাত্র ৪টি রুটে বিন্যাস করা হচ্ছে। পিংক সার্ভিসের এই ৪টি রুটের মধ্যে পিংক ১ নম্বর রুট বিন্যাস করা হয়েছে- কোনাবাড়ি, মৌচাক, গাজীপুর ভায়া কুড়িল, শিমরাইল, পোস্তগোলা। পিংক ২ নম্বর রুট হলো- কাপাশিয়া, কোনাবাড়ি, গাজীপুর ভায়া কুড়িল, সদরঘাট, ঝিলমিল। পিংক ৩ নম্বর রুট হলো- শ্রীপুর, কোনাবাড়ী, গাজীপুর, ভায়া কুড়িল, মিরপুর, গাবতলী। পিংক ৪ নম্বর রুট হলো- চেরাগআলী, গাজীপুর ভায়া কুড়িল, আজিমপুর। এসব এলাকায় বর্তমানে ৪৬টি রুটে ১১৩২টি বাস ও ৮৪৯টি মিনিবাস মিলে মোট ১৯৮১টি বাস চলাচল করছে।
একই রকম প্রস্তাবিত ব্লু সার্ভিসের এলাকাগুলোতে দুইটি রুট বিন্যাস করা হয়েছে। এগুলো ব্লু ৫ নম্বর রুটের গাড়ি চলছে কালিয়াকৈর, চন্দ্রা, বাইপাইল, আশুলিয়া ভায়া কুড়িল, সদরঘাট ও ঝিলমিল। ব্লু ৬ নম্বর রুটের গাড়ি চলবে কালিয়াকৈর, চন্দ্রা, বাইপাইল ভায়া আশুলিয়া, শিমরাইল। এই দুইটি রুট এরিয়ায় বর্তমানে ২২টি রুটে ৪৪৪টি বাস ও ৫২৪টি মিনিবাস মিলিয়ে মোট ৯৬৮টি বাস চলাচল করছে। এই বাসগুলোর যতো কোম্পানি রয়েছে তাদের ব্লু সার্ভিস কোম্পানির আওতায় আনা হবে।
পেস্ট সার্ভিসকে মাত্র ৩টি রুটে বিন্যাস করা হয়েছে। এর মধ্যে পেস্ট ৭ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে চন্দ্রা, ইপিজেড, নবীনগর, হেমায়েতপুর ভায়া গাবতলী, শিমরাইল ও স্টাফ কোয়ার্টার। পেস্ট ৮ নম্বর রুটের গাড়ি চলবে মানিকগঞ্জ, কালামপুর, ধামরাই, সাভার ইপিজেড ভায়া গাবতলী, সদরঘাট ও ঝিলমিল। এবং পেস্ট ৯ নম্বর রুটের গাড়ি চলবে চন্দ্রা, ধামরাই, জিরানী বাজার, ইপিজেড, কালামপুর ভায়া গাবতলী, মিরপুর, আব্দুল্লাহপুর। এসব এলাকার রাস্তায় বর্তমানে ৫৩টি রুটে ১২৯০টি বাস ও ৪৬৮টি মিনিবাস মিলিয়ে মোট ১৭৫৮টি বাস চলাচল করছে।
অরেঞ্জ সার্ভিসকে ৭টি রুটে বিন্যাস করা হয়েছে। এর মধ্যে অরেঞ্জ ১০ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে মিরপুর থেকে শিমরাইল রোডে। অরেঞ্জ ১১ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে চিড়িয়াখানা, দুয়ারিপাড়া ভায়া পল্লবী, সদরঘাট, ঝিলমিল ও পোস্তগোলা রোডে। অরেঞ্জ ১২ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে চিড়িয়াখানা, দুয়ারিপাড়া ভায়া পল্লবী, নতুন বাজার। অরেঞ্জ ১৩ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে চিড়িয়াখানা, দুয়ারিপাড়া, ভায়া পল্লবী, আজিমপুর, মতিঝিল, তালতলা, সাইনবোর্ড ও ধুপখোলা। অরেঞ্জ ১৪ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে চিড়িয়াখানা, পল্লবী, কমলাপুর রোডে। অরেঞ্জ ১৫ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে মিরপুর, বেরাইদ, মেরাদিয়া, আমোলিয়া ও স্টাফ কোয়ার্টার। এবং অরেঞ্জ ১৬ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে মিরপুর, আগারগাঁও, পঙ্গু হাসপাতাল ও আজিমপুর রোডে। প্রস্তাবিত অরেঞ্জ সার্ভিসের এসব এলাকায় বর্তমানে ৭১ রুটে ১২৪৩টি বাস ও ৫৮২টি মিনিবাস মিলিয়ে মোট ১৮২৫টি বাস চলাচল করছে।
ইয়েলো সার্ভিসকে তিনটি রুটে বিন্যাস করা হয়েছে। ইয়েলো ১৭ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে আটিবাজার, বসিলা, মোহাম্মদপুর, শিমরাইল, বনশ্রী, খিলগাঁও, পোস্তগোলা। ইয়েলো ১৮ নম্বর রুটের গাড়ি চলবে বসিলা, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা রোডে। এবং ইয়েলো ১৯ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে নবাবগঞ্জ, মাওয়া, ফুলবাড়িয়া ও মিরপুর রোডে। এসব এলাকায় বর্তমানে ২৮টি রুটে ৫৮৮টি বাস ও ৭০টি মিনিবাস মিলিয়ে ৬৫৮টি বাস চলাচল করছে।
গ্রিন সার্ভিসকে তিনটি রুটে বিন্যাস করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রিন ২০ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে নারায়ণগঞ্জ, মতিঝিল, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর। গ্রিন ২১ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে ভূলতা, ঘোড়াশাল, কালিগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান ও চানখাঁরপুল। এবং গ্রিন ২২ নম্বর রুটের গাড়ি চলাচল করবে মেঘনাঘাট, মদনপুর, আব্দুল্লাহপুর ও পলাশী। এসব এলাকায় বর্তমানে ২৬টি রুটে ৪০৭টি বাস ও ৩৪০টি মিনিবাস মিলিয়ে মোট ৭৪৭টি বাস চলাচল করছে।
উল্লেখ্য, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকার বিশৃঙ্খল নগর পরিবহনগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য ‘বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। প্রকল্প অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে বিদ্যমান বাস কোম্পানিগুলোকে একীভূত করে সমন্বিত কোম্পানি করে যানজট নিরসন করার কথা ছিল। এতে প্রতিটি বাস অপর বাসের সঙ্গে যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি না করে একটির অপরটির পিছে চলার কথা। একই সঙ্গে বাসগুলো যেখানে সেখানে যাত্রী না উঠিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো ও টিকিটের বিনিময়ে যাত্রী পরিবহন করার কথা। এই লক্ষ্যে হ্যাভিটেড কনসালট্যান্ট লি. নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বাস রুটগুলোকে একীভূত করার কর্মপরিকল্পনা ও মাঠ পর্যায়ের জরিপ সম্পন্ন করেন মেয়র আনিসুল হক। মেয়রের জীবদ্দশায়ই প্রকল্পের জরিপ ও ডিজাইনের সিংহভাগ কাজ শেষ করে কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান। লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু মেয়রের মৃত্যুতে প্রকল্পটি ঝিমিয়ে পড়ে।
তবে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘হ্যাভিটেড কনসালটেন্ট লি.’-এর চিফ এডভাইজার ড. এসএম সালেহউদ্দিন মানবজমিনকে জানান, মেয়রের মৃত্যুতে আমরা অভিভাবক হারা হয়ে যাই। কিন্তু কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও অন্য কর্মকর্তাদের প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রকল্পের বিস্তারিত দেখিয়েছি। শুধু মেয়র মহোদয়কে চেষ্টা করলেও দেখানোর সুযোগ পাইনি। তিনি বলেন, এই পদ্ধতি চালু হওয়া নিয়ে মালিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এতে তারাই লাভবান হবে। বাসযোগ্য ঢাকা ও ভালো একটি পরিবহন ব্যবস্থা উপহার দেয়া ছাড়া আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। এতে মালিকরা নিজেদের মতো করে গাড়ি চালাবে। সরকার বা সিটি করপোরেশন শুধু দেখবে তারা সরকারের নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি চালাচ্ছে কিনা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, এই প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী উত্তরের মেয়র মহোদয়কে দক্ষিণের মেয়রের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উত্তরের মেয়র মারা যাওয়ায় কাজ থেমে যায়। এখন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। কাজ শুরু হলে কিছু সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তবে নতুন কোনো ধারণা নয়, এই একীভূতকরণ পদ্ধতিই বাস্তবায়ন হবে।

No comments

Powered by Blogger.